দেশে কত ধরনের বিনিয়োগকারী যে আছেন! ঝুঁকি আছে জেনেও কেউ টাকা খাটান শেয়ারবাজারে। কারও কারও ঝুঁকি কাজেও লেগে যায়। ভালো মুনাফা পান তাঁরা। কেউ কেউ আবার বেশ পস্তান। মাঝে মাঝে এমন অবস্থাও দাঁড়ায় যে পুঁজি হারিয়ে উল্টো বাড়ি থেকে এনে বাড়তি টাকাও দিয়ে আসতে হয় মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে।
কেউ উচ্চ সুদের প্রলোভনে পড়ে সমবায় সমিতিতে টাকা বিনিয়োগ করেন। যদিও এমন খবরের শিরোনাম বিরল নয় যে গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে সমবায় সমিতির কর্তারা উধাও।
বাকি থাকে ব্যাংকে স্থায়ী হিসাব (এফডিআর) খোলা ও জমি কেনা। তবে এখনকার মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ব্যাংকে টাকা রাখলে বছর শেষে উল্টো লোকসানই হচ্ছে। আর জমি কেনার মূল সমস্যা হচ্ছে জমিটা নিষ্কণ্টক কি না, তা বুঝতে পারা। বিশেষ করে শহর এলাকায় জমি কেনার ঝক্কিও কম নয়।
যেকোনো বিচারে হিসেবি বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাত হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। কিন্তু এখন কেউ কেউ সঞ্চয়পত্র ভেঙেও সংসার চালাচ্ছেন, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। আরেক শ্রেণি আছে তুলনামূলক সম্পন্ন, সংসার চলছে স্বাভাবিক আয়ে। বাড়তি আয়ের জন্য নতুন বিনিয়োগ করতে তাঁরা সঞ্চয়পত্রকেই বেছে নিচ্ছেন। এ শ্রেণির মানুষের জন্যই আজকের আলোচনা।
আমরা সবাই জানি, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির খড়্গ আছে। টাকার মান কমে যাচ্ছে। আজকে যে জিনিস ১০০ টাকায় পাওয়া যায়, এক বছর পর সেই জিনিসই কিনতে লাগবে ১০৬ থেকে ১১০ টাকা। ব্যাংকগুলো এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দেয়। সে হিসাবে ব্যাংকে টাকা জমালে প্রকৃত বিবেচনায় কোনো লাভ নেই।
তার পরও অনেক বিনিয়োগকারী ব্যাংকেই টাকা রাখেন এবং তাঁরা তা রাখেন এফডিআর আকারেই। এখানে তাঁদের অন্য হিসাব আছে। যখন-তখন চাইলেই এ হিসাব ভাঙিয়ে টাকা নগদ করে ফেলা যায়।
সঞ্চয়পত্র কি তাহলে আগে ভাঙানো যায় না? যায়। তবে সে ক্ষেত্রে লাভ কম হয়। আর শেয়ার কেনার পর তার দাম কমে গেলে সাধারণত কেউ বিক্রি করতে চান না। করলেও লোকসানে বিক্রি করতে হয়। অন্যদিকে জরুরি টাকার দরকার হলে জমি বিক্রি করে নগদ অর্থ করা খুব সহজ কাজ নয়।
সঞ্চয়পত্রেই তাই অনেকে ভরসা রাখতে চান। তবে আগের মতো চাইলেই এখন আর কেউ যে কোনো পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। দুই লাখ টাকার বেশি অঙ্কের সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর (ইটিআইএন) থাকতে হয়। দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্য ইটিআইএন লাগে না।
একসময় সঞ্চয়পত্র কিনতে বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ছাপানো ফরম পূরণ করতে হতো। সেই দিন ফুরিয়েছে কয়েক বছর আগেই। সব ধরনের সঞ্চয়পত্রেরই এখন নির্দিষ্ট ফরম রয়েছে, যা ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যায়।
সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে গ্রাহকদের আগে এ ফরম পূরণ করতে হয়, সঙ্গে দিতে হয় গ্রাহক ও নমিনির দুই কপি করে পাসপোর্ট আকারের ছবি। গ্রাহকের ছবি সত্যায়িত করতে হয় প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর মাধ্যমে। তবে নমিনির ছবির সত্যায়ন করতে হয় গ্রাহককেই।
গ্রাহক ও নমিনির জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও এ ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া গ্রাহকের নিজ ব্যাংক হিসাবের চেকের কপি, যে হিসাবে গ্রাহকের মুনাফা বা সুদ ও আসল টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হবে, সে হিসাবের নম্বর লাগে। পেনশনার সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বাড়তি কাগজ হিসেবে লাগে সর্বশেষ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সনদ।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র—বর্তমানে এ চার ধরনের সঞ্চয়পত্র চালু রয়েছে। নামের মধ্যেই রয়েছে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র পাঁচ বছর মেয়াদের।
পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের নামের মধ্যে মেয়াদ উল্লেখ না থাকলেও দুটি সঞ্চয়পত্রই পাঁচ বছর মেয়াদের। এ ছাড়া রয়েছে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ মাসিক ভিত্তিতে এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে তোলা যায়।
এ প্রশ্নের এক শব্দের জবাব হচ্ছে ‘না’। সবাই সব ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। এ ব্যাপারে সরকার কিছু শর্ত ঠিক করে দিয়েছে। যেমন ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের যেকোনো বাংলাদেশি নারী, যেকোনো বাংলাদেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষ এবং ৬৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী বাংলাদেশি নারী ও পুরুষেরা শুধু একক নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।
পেনশনার সঞ্চয়পত্রও কিনতে পারেন না সবাই। অবসরভোগী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত সরকারি চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানেরা এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র সবার জন্য উন্মুক্ত। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ একক বা যুগ্ম নামে এ দুই ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। নাবালকের পক্ষে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ একসময় থাকলেও এখন আর নেই।
পরিবার সঞ্চয়পত্রে এক লাখ টাকায় মাসিক মুনাফা পাওয়া যায় ৮৬৪ টাকা। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ত্রৈমাসিক মুনাফা ২ হাজার ৪৮৪ টাকা। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ত্রৈমাসিক মুনাফা ২ হাজার ৬৪৬ টাকা। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে একেক বছরের জন্য একেক হারে মুনাফা পাওয়া যায়।
সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক কোনো কারণে মারা গেলে টাকা পাবেন তাঁর মনোনীত ব্যক্তি বা নমিনি। সঞ্চয়পত্রে এক বা একাধিক নমিনি করার সুযোগ রয়েছে। যদিও নমিনি মনোনয়ন বাধ্যতামূলক নয়। তবে ভবিষ্যতে নগদায়ন ঝামেলা এড়াতে গ্রাহকেরা সাধারণত নমিনি মনোনয়ন দিয়েই থাকেন।
এমনকি নাবালককেও নমিনি করা যায়। গ্রাহকের মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যে আদালত থেকে উত্তরাধিকার সনদ নিয়ে সঞ্চয়পত্রের নগদায়ন করতে হয়। গ্রাহক ও নমিনি উভয়ই মারা গেলে আইনানুগ উত্তরাধিকারীরা সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে পারেন।
৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ, ৫ লাখ ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের পেনশনার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। আর পরিবার সঞ্চয়পত্র রয়েছে ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ, ৫ লাখ ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের।
এগুলো কেনা যায় জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ৭১টি সঞ্চয় ব্যুরো কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কার্যালয়, সব তফসিলি ব্যাংক ও সব ডাকঘর থেকে। একই জায়গা থেকে ভাঙানোও যায়। ভাঙানোর দিন গ্রাহককে সশরীর উপস্থিত হয়ে আবেদন করার নিয়ম রয়েছে।
ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখলে তার বিপরীতে জরুরি প্রয়োজনে দুই দিনের নোটিশে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যায়। কিন্তু সঞ্চয়পত্র জামানত রেখে কোনো ব্যাংকঋণ নেওয়া যায় না।
সঞ্চয়পত্র হারালে, চুরি হলে, পুড়ে গেলে বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হলে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের পর ডুপ্লিকেট কপি পাওয়া যায়। সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে এক বছর পার হওয়ার আগেই কেউ ভাঙাতে চাইলে কোনো মুনাফাই দেওয়া হয় না। শুধু মূল টাকা ফেরত নিতে হয়।
কেউ যদি মনে করেন জরুরি অর্থের দরকারে বিনিয়োগটা তিনি নষ্ট করবেন না, তার জন্য সঞ্চয়পত্র নয়। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকে এফডিআর করাই সে ধরনের বিনিয়োগকারীদের জন্য উত্তম হবে।
২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে আসল ও মুনাফার টাকা আর নগদে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙালেও টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাচ্ছে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে। গ্রাহকের মনোনীত ব্যক্তি মুনাফার টাকা তুলতে পারলেও মূল টাকা গ্রাহক ছাড়া অন্য কেউ তুলতে পারেন না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের ঋণবিষয়ক শর্ত দিয়েছে। শর্তটি সহজ। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে নেওয়া ঋণের পরিমাণকে সরকারের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের এক-চতুর্থাংশের মধ্যে রাখতে বলেছে আইএমএফ। চলতি বছরের হিসাবে তা ২৩ শতাংশ।
বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
২০২৬ সালের জুনে বাজেট করার সময় মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ যদি আড়াই লাখ কোটি টাকা হয়, তাহলে ৬২ হাজার কোটি টাকা সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সংগ্রহ করতে পারবে। ফলে আইএমএফ বিক্রি কমিয়ে দিতে যে পরামর্শ দিয়েছে, তাতে খুব উদ্বেগের কিছু নেই। চলতি অর্থবছরে মানুষ সংকটে থাকার কারণে অবশ্য মানুষ এমনিতেই সঞ্চয়পত্রে খুব একটা বিনিয়োগ করতে পারছেন না।