তথ৵ প্রযুক্তি

যেভাবে জন্ম নিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘চ্যাটজিপিটি’

চ্যাটজিপিটি এখন সর্বত্র। বিশ্বের প্রায় সব গণমাধ্যমেই এখন প্রতিদিন এ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে চলছে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী বিল গেটসও মনে করেন চ্যাটজিপিটি বিশ্বকে আমূল বদলে দেবে। কারও কারও ধারণা, নতুন এ প্রযুক্তিসেবার কারণে বেকার হয়ে যাবে লাখ লাখ তরুণ-যুবা।

চ্যাটজিপিটি চালুর মাত্র দুই মাসের মধ্যে ১০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। বয়স-পেশানির্বিশেষে সবাই এখন চ্যাটজিপিটির সঙ্গে ‘কথা’ বলতে চান। যদিও নতুন এই প্রযুক্তির সঙ্গে কথা বলতে হয় কি-বোর্ডে টাইপ করে। কারণ, চ্যাটজিপিটির নামই বলছে এটি একটি চ্যাট বট!

ইন্টারনেটের নতুন এই সেনসেশন জন্ম গত ডিসেম্বরে। যদিও তারও বেশ আগে থেকে টের পাওয়া যাচ্ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জগতে একটা কিছু ঘটতে চলছে। প্রায় চার দশক ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে বা কোনো বড় প্রযুক্তি কোম্পানির আঁতুড়ঘরে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি ব্যতিক্রম। সেটি কীভাবে? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

আশির দশকেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম কাজ ছিল এমন একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যা মানুষের মতো ‘শিখতে’ পারবে। এটিকে বলা হতো নিউরাল নেটওয়ার্ক। এ ক্ষেত্রে মুশকিল ছিল এমন নেটওয়ার্ক কিছু শিখতে পারলেও ‘পুরোনো’ শেখা বিষয়গুলো ভুলে যেত। কিন্তু ১৯৯৭ সালে দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

ওই বছর দুজন কম্পিউটারবিজ্ঞানী—স্যাপ হর্চরিইটার ও জার্গেন স্কিমিদুবার এলএসটিএম নামে নতুন একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। এলএসটিএম হলো লং অ্যান্ড শর্ট টার্ম মেমোরি, যা কিনা ক্রমবর্ধমান টেক্সট ডেটা ‘মনে’ রাখতে পারে লম্বা সময়ের জন্য।

১৯৯৭ সালটা ছিল প্রযুক্তিজগতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। কারণ, ওই বছরই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পিএইচডি ছাত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্য খোঁজার সার্চ ইঞ্জিনের আমূল পরিবর্তন করেন। পরের বছরই জন্ম হয় গুগলের। তখন ধারণাও করা যায়নি, একদিন গুগল ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হয়ে উঠবে।

অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে আইবিএমের বানানো সুপার কম্পিউটার ‘ডিপ ব্লু হারিয়ে’ দাবা খেলায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দেয়। ডিপ ব্লুর কোনো চিন্তা বা ভাবনার শক্তি ছিল না। কিন্তু দ্রুততম সময়ে কোটি কোটি চালের ক্ষমতা দাবা খেলায় তাকে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে যায়।

পরবর্তী দশকজুড়ে ইন্টারনেটের বিকাশ, সার্চ ইঞ্জিনের আধিপত্য, ই-কমার্স সাইটের আবির্ভাব ইত্যাদিতে মানুষ ব্যস্ত থাকায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ কিছুটা পিছিয়ে যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্টার্টআপ জগতেই সেটির আনাগোনা বাড়তে থাকে।

এর মধ্যে ২০১০ সালে সিলিকন ভ্যালি থেকে শত শত মাইল দূরে যুক্তরাজ্যে কয়েকজন কেমব্রিজ গ্র্যাজুয়েট ‘ডিপমাইন্ড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল—এমন একটি নিউরাল নেটওয়ার্কনির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা, যেটি ভিডিও গেম খেলতে পারবে। ২০১৪ সালে আধা-বিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারে গুগল ‘ডিপমাইন্ড’ কিনে নেয়। তখন থেকে ডিপমাইন্ড গুগলের মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়। ডিপমাইন্ডের নিভৃত গবেষণা ২০১৬ সালে ব্যাপক আলোচনায় আসে।

তাঁদের বানানো আলফাগো নামের কম্পিউটার প্রোগ্রাম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লি সিডলকে প্রাচ্যের মাথা ঘামানোর খেলা ‘গো’তে হারিয়ে দেয়। দাবা খেলার সঙ্গে গো খেলার পার্থক্য এর চালের ভিন্নতার বৈচিত্র্যের জন্য। শুধু অঙ্ক করে বা পুরোনো চাল জেনে এই খেলায় জেতা যায় না। আলফাগোর সাফল্য আবারও সবাইকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং, রোবোটিকস ইত্যাদির আলোচনায় ফিরিয়ে আনে। সে বছরই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের কর্তাব্যক্তি ক্লাউস শোয়েবের ‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভোলিউশন’ বা ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ বই প্রকাশিত হয়। হঠাৎ করে বিশ্ববাসী আবিষ্কার করে তারা এক নতুন বিপ্লবের মুখোমুখি, যেখানে যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের বিভাজন রেখা ক্রমে আবছা হয়ে উঠছে।

লন্ডন থেকে অনেক দূরে সেই সময় ৫-৬ জন লোক মিলে এক কফির আড্ডায় ভাবেন—আরে, কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা যদি একসময় পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, আর সেটা যদি গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ তো তার সুফল পাবে না। তখন তারা সবাই মিলে এক বিলিয়ন (এক শ কোটি) ডলার চাঁদা তুলে একটি অলাভজনক ফাউন্ডেশন তৈরি করেন। যার নাম দেওয়া হয় ‘ওপেন এআই’। লক্ষ্য ঠিক করা হয় মানবজাতির কল্যাণে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার ব্যবহার। ফাউন্ডেশনটির উদ্যোক্তারা হলেন, স্যাম অল্টম্যান (বর্তমান প্রধান নির্বাহী), গ্রেগ ব্রকম্যান, রিড হফম্যান (লিংকডইনের প্রতিষ্ঠাতা), জেসিকা লিভিংস্টোন, পিটার থিল (পেপালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা) ও ইলন মাস্ক (পেপাল, টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা)। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস, ইনফোসিস ও ওয়াইসি রিসার্চ। সান ফ্রান্সসিসকোতে ফাউন্ডেশনটির সদর দপ্তর। শুরু হয় নতুন একটি মিশন। ২০১৮ সালে টেসলার সঙ্গে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হতে পারে মনে করে ইলন মাস্ক ওপেন এআই থেকে সরে আসেন। তারপরই মাইক্রোসফটের বিনিয়োগ নেওয়ার জন্য উদ্যোক্তারা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানও তৈরি করেন।

প্রথাগত পথেই এগোচ্ছিল গবেষণা। ২০১৭ সালে গুগলের কয়েকজন গবেষক ট্রান্সফরমার নামে নিউরাল নেটওয়ার্কের নতুন একটা মডেল বের করেন। একটা বড় বাক্য বা প্যারাগ্রাফের মধ্যে কোন শব্দ বা বাক্যাংশ কোথায় আছে, সেটা বের করা ছিল এ মডেলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

অনেক সময় কোনো শব্দের অর্থ তার আশপাশের শব্দের কারণে পুরোপুরি বদলে যায়। ট্রান্সফরমার তখন “Hot dogs should be given plenty of water” এবং “Hot dogs should be eaten with mustard” এই বাক্যের হট ডগকে আলাদা করতে পারে। গুগল গবেষকদের ওই নিবন্ধ প্রকাশের পরপরই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে এই দিকে।

২০১৮ ও ২০১৯ সালের মধ্যে ওপেন এআই জিপিটি (Generative Pre-trained Transformer) ও জিপিটি-২ মডেল প্রকাশ করে। ট্রান্সফরমারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় তত্ত্বাবধায়কহীন শেখার প্রসেস। আগে নিউরাল নেটওয়ার্ককে সমৃদ্ধ করার জন্য যে ডেটা ব্যবহার করা হতো, সেগুলোকে ‘বিশেষভাবে চিহ্নিত’ করা হতো, যাতে মডেল বুঝতে পারে। কিন্তু জিপিটিতে সেটা বাদ দেওয়া হলো। এর মানে হলো, এ রকম একটা ইঞ্জিন আপনার সঙ্গে চ্যাট করেই নতুন কিছু শিখে ফেলতে পারে। ওপেন এআইয়ের জিপিটি-৩ মডেল মানুষের মতো ‘কথা’ বলার সক্ষমতা লাভ করে।

এরপরই গত ডিসেম্বরে এই মডেলের ওপর ভিত্তি করে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার চ্যাট বট ‘চ্যাটজিপিটি’ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মাত্র দুই মাসের মধ্যে এটি ১০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এর আগে সমপরিমাণ লোকের কাছে পৌঁছাতে টিকটকের লেগেছিল ৯ মাস আর ইনস্টাগ্রামের দুই থেকে আড়াই বছর।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের হিসাবে, ২০২৩ সালে ওপেন এআইয়ের আয় হবে ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলার। শোনা যায় মাইক্রোসফট ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সময় এর ভ্যালুয়েশন ধরেছিল মাত্র ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা বার্ষিক আয়ের ১০০ গুণেরও বেশি।

চ্যাটজিপিটি তথা জিপিটি-৩ আগামী বিশ্বের জন্য একটি পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠবে বলেই সবার ধারণা। যেমনটা ২০০৭ সালে আইফোনের আবির্ভাবের মাধ্যমে একবার ঘটেছিল।