বাজেট ২০২৩–২৪

আইএমএফ চায় কমুক, সরকার বাড়াচ্ছে ভর্তুকি 

ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে তা ছিল ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রত্যাশা করে আসছে বাংলাদেশের বাজেটে ভর্তুকি কমুক, তা না হলেও ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা যৌক্তিক হোক। ভর্তুকি কমিয়ে সে অর্থ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে ব্যয়ের পরামর্শও দিয়ে আসছে বৈশ্বিক সংস্থাটি। কিন্তু সরকার নতুন বাজেটে আইএমএফের সেই পরামর্শ না মেনে উল্টো ভর্তুকি বাড়াচ্ছে। 

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের সংক্ষিপ্ত-সার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এবারের বাজেটে ভর্তুকি দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং নগদ ঋণ ও অগ্রিম মিলেই হচ্ছে এই অঙ্ক। প্রণোদনা এবং নগদ ঋণ ও অগ্রিমকে ভর্তুকি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। নতুন বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৮৪ হাজার ২ কোটি, প্রণোদনায় ১৫ হাজার ২২৫ কোটি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত সংস্থাগুলোকে ঋণ দিতে ১১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে মূল বরাদ্দ ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় ৯৮ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। 

বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পাওয়ার আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যৌথভাবে সংস্থাটিকে জানিয়েছিলেন, তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) আর বাজেট সহায়তা দিতে হবে না। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের জন্য সময়ভিত্তিক উপায় বের করা হবে। বিদ্যুৎ খাতেও ভর্তুকি কমানো হবে। এ জন্য সরকারকে স্বাগত জানায় আইএমএফ। 

■ এবারের বাজেটে ভর্তুকি দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং নগদ ঋণ ও অগ্রিম মিলেই হচ্ছে এই অঙ্ক। প্রণোদনা এবং নগদ ঋণ ও অগ্রিমকে ভর্তুকি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। 

■ ভর্তুকির ৮৪ হাজার ২ কোটি টাকার মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ হাজার কোটি ও কৃষি খাতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ ছাড়া এলএনজি, নগদ সহায়তা, খাদ্য—এসব খাতে ব্যয় হবে বাকি ভর্তুকি।

ভর্তুকি নিয়ে অর্থমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার বাজেট বক্তব্যে তেমন কিছু বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি যন্ত্রপাতি, পুনর্বাসন, গবেষণা ও উদ্ভাবন, কৃষি খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের ওপর নজর দিতে হয়েছে। ভর্তুকি, সুদ ব্যয় ইত্যাদি খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধি, বিনিময় হারের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখেছি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ‘বিনিয়োগ ভবন’ উদ্বোধনকালে ভর্তুকি কমানোর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।’ প্রধানমন্ত্রী ওই দিন আরও বলেন, ‘ইংল্যান্ড ১৫০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এটা সবার মনে রাখতে হবে। আমরা কিন্তু সেই পর্যায়ে যাইনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ দেওয়া
যাবে ক্রয়মূল্যে। আর কত ভর্তুকি দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে কেন দেব? আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি কৃষিতে, খাদ্য উৎপাদনে।’ 

নতুন বাজেটে ভর্তুকির ৮৪ হাজার ২ কোটি টাকার মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ হাজার কোটি ও কৃষি খাতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ ছাড়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), নগদ সহায়তা, খাদ্য—এসব খাতে ব্যয় হবেবাকি ভর্তুকি।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাট খাতে ১ হাজার ২০০ কোটি ও প্রবাসী আয় দেশে আনার জন্য রাখা হয়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাকি টাকার উল্লেখযোগ্য অংশ রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা হিসেবে দেওয়া হবে। 

নগদ ঋণ ও অগ্রিম বাবদ রাখা ১১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে পণ্য বিক্রয়কারী সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন, পাটকল করপোরেশন ইত্যাদির জন্য। ঋণ আকারে দেওয়া হলেও এ টাকা সরকার আর ফেরত পায় না। ফলে এটাকেও এক অর্থে ভর্তুকি বলে বিবেচনা করা হয়। 

ভর্তুকি নিয়ে অর্থ বিভাগ গত নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলেছিল, সারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে এত বেড়েছে যে এক কৃষি খাতেই বাড়তি ভর্তুকি লাগতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে সারে ভর্তুকির সম্ভাব্য পরিমাণ ৪৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা ধরে অর্থসচিবকে গত অক্টোবরেই চিঠি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

আর টিসিবি এক কোটি মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করায় অর্থ বিভাগ বাড়তি ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা দাবি করেছিল। অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু তেল–গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, সেহেতু নতুন ভর্তুকি বাড়বে না। তবে পুরোনোগুলোর জন্য ভর্তুকি রাখতে হবে। আবার বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, অর্থনীতি এখনো ওই পর্যায়ে উন্নীত হয়নি যে ভর্তুকি তুলে দিতে হবে। 

তবে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার পর প্রণোদনা বাবদ বাজেটে বরাদ্দ রাখা যাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। 

কয়েক দিন আগে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী খাদ্যে ও কৃষিতে ভর্তুকি থাকলেও অন্যগুলো থেকে বের হওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে।’