প্রতীকী ছবি
প্রতীকী  ছবি

ব্যবসায়ীরা ‘অস্বস্তিতে’, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। নতুন কর্মসংস্থান তৈরির হারও ছিল প্রয়োজনের চেয়ে কম। এখন শুরু হয়েছে নতুন সংকট। সেটি হলো ব্যবসায়ীদের অস্বস্তি, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা।

সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বিনিয়োগ কম হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে এই প্রবণতা দেখা যায়। এ বছরের ৭ জানুয়ারি একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে দেশ আরও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে মাত্র ১০০ দিনের কিছু বেশি সময় হলো। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্রমিক আন্দোলনে কারখানায় উৎপাদনে বিঘ্নিত হয়েছে। নিয়মিত বিভিন্ন পক্ষ ঢাকায় নানা দাবিতে আন্দোলন করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটেনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ কম হয়।

বিনিয়োগ কম হওয়ার মানে হলো কম কর্মসংস্থান, বেশি বেকারত্ব। আবার অর্থনীতিতে গতি কমে গেলে মানুষের আয় বৃদ্ধির গতিও কমে যায়। ১০ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতির মধ্যে সেই হারে আয় না বাড়লে মানুষের কষ্ট বাড়ে।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা তাই কারখানা, ব্যবসা ও বাণিজ্য সচল রাখার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন; কিন্তু তাঁরা এ–ও বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা যতটা থাকা দরকার, সমস্যা সমাধানে যতটা উদ্যোগ দরকার, সেখানে গত তিন মাসে ঘাটতি ছিল। এর মধ্যে ১০ নভেম্বর সরকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য একজনকে উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছে, তিনি ব্যবসায়ী শেখ বশিরউদ্দিন। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, এখন যোগাযোগ বাড়বে।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ব্যবসার প্রতিটি খাতে প্রভাব পড়ছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থাহীনতা আছে, সেটি বলা যাবে না; তবে অস্বস্তি আছে। কারণ, ধারণা করা যায় না এমন ভবিষ্যৎ (আনপ্রেডিক্টেবল ফিউচার) নিয়ে কেউ নতুন বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবেন না। তিনি বলেন, ‘একেক দিন একেক শ্রেণি–গোষ্ঠীর মানুষ দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছেন। আমরা জানি না, আগামী সপ্তাহে কী হবে। তিন মাস বা ছয় মাস পরে কেমন পরিস্থিতি থাকবে—আমরা এর নিশ্চয়তা চাই।’

আবুল কাসেম খান আরও বলেন, ব্যবসা–সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। ঘন ঘন আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সব খাতে সংস্কারের কথা শুনছি; কিন্তু ব্যবসায় খাতে সংস্কারের কথা শুনছি না। ব্যবসায় শুরু ও পরিচালনার প্রতিটি ধাপ সহজ করতে হবে।’

বিনিয়োগ পরিস্থিতি

বিনিয়োগ পরিস্থিতির হালনাগাদ কোনো তথ্য-উপাত্ত এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে কিছু কিছু সূচকে বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝা যায়। এর একটি হলো বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে, যা ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে আসা বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েও ব্যবসায়ীদের আস্থার পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। বিডার তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৮৬টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। টাকার অঙ্কে যা ১৯ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। আগের তিন মাসের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। ওই সময়ে ২৫৪টি প্রতিষ্ঠান ৭৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল। উল্লেখ্য, প্রস্তাব মানেই প্রকৃত বিনিয়োগ নয়।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। গত আগস্ট পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নমুখী ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে এসব সূচক ঊর্ধ্বমুখী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগ ২২-২৩ শতাংশেই ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছিল ৭ শতাংশের বেশি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হিসাব মিথ্যা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের প্রবৃদ্ধিকে ‘কর্মসংস্থানহীন’ বলেও উল্লেখ করতেন অর্থনীতিবিদেরা।

বেকারত্বের হাল

সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০-২২ লাখ তরুণ নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ১২-১৩ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়; আর প্রতিবছর ৮-৯ লাখ মানুষ বিদেশে যান।

গত তিন মাসে বেকারত্বের পরিস্থিতি কী দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি বিবিএস। বেকারত্বের তথ্য-উপাত্ত তাই পুরোনো। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, তখন দেশের বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এই বেকার তরুণ-তরুণীর মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ৭ লাখ ৯৯ হাজার। এর মানে হলো, মোট বেকারের প্রায় ৩১ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত।

দেশের মোট বেকারের ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখের মতো হলেও পছন্দমতো কাজ পান না প্রায় পৌনে এক কোটি তরুণ-তরুণী।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার পেছনেও ছিল কর্মসংস্থানের সংকট। সেই আন্দোলনে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হলে তা রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে।

সরকার কী করছে

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে ২ লাখ ২২ হাজার ৮১২ কর্মী বিদেশে গেছেন। এ সময় ১ হাজার ২১৫টি কারখানা, দোকান ও প্রতিষ্ঠানকে নতুন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

আগামী তিন মাসে কী করা হবে, সেই পরিকল্পনাও আছে সরকারের। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে আগামী তিন মাসে ৬০ জন স্টার্টআপকে (নতুন উদ্যোগ) অনুদান দেওয়া হবে। ৫০০ ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাকে ব্যবসা শুরুর জন্য অনুদান দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিপ্রক্রিয়া সহজ করতে আগামী তিন মাসে একটি জাতীয় জব পোর্টাল তৈরি করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ১৭ নভেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ১০০ দিনের কার্যক্রমের অগ্রগতি–সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ১০০ দিনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন ৮৬ হাজার ২৭৭ জনের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।

‘পুরোনো বোঝাপড়া ভেঙে গেছে’

ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির ধরনটা ভিন্ন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর বেশির ভাগ আত্মগোপনে অথবা কারাগারে। ফলে তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাপে রয়েছে। দেশের বড় কিছু শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং অনিয়ন-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ পর্যায়ে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ হয় একধরনের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। পুরোনো বোঝাপড়া ভেঙে গেছে। নতুন বোঝাপড়া তৈরি হবে। গণতান্ত্রিক উত্তরণে অনিশ্চয়তা থাকলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতির আশা নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত গণতান্ত্রিক উত্তরণের একটি পথনকশা ঘোষণা করা, অনিশ্চয়তার ক্ষেত্রগুলো দূর করার উদ্যোগ নেওয়া।

সেলিম রায়হানের মতে, রূপান্তরের সময়ে বাড়তি কর্মসংস্থান তৈরির জন্য সরকারি খালি পদগুলো পূরণে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া যায়। সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ১০০ দিনের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো বিশেষ প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সচল থাকে, কর্মীরা বেতন-ভাতা পান, সে ক্ষেত্রেও সরকারের একটি কৌশল থাকতে হবে।