উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধা রেখে সম্প্রতি সর্বজনীন পেনশন তহবিল আইন সংসদে পাস হয়েছে। আপাতত সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছাড়াও দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিক সর্বজনীন পেনশন তহবিলে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। নিম্ন আয়ের নাগরিক এবং দুস্থ নাগরিকেরা সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান, তহবিলে প্রদানকৃত চাঁদার ওপর কর রেয়াত এবং প্রাপ্ত পেনশন করমুক্ত সুবিধা রেখে এই আইন পাস করা হয়েছে।
এই তহবিলে কত টাকা চাঁদা দেওয়া যাবে, জমাকৃত টাকার ওপর বছর শেষে কত হারে মুনাফা পাওয়া যাবে এবং কত টাকা করে রাখলে অবসরে যাওয়ার পর মাসিক কত টাকা পাওয়া যাবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।
বিষয়গুলো যখন একজন নাগরিক জানতে পারবেন, তখন পেনশন তহবিলের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়বে। আর একজন নাগরিক এ তহবিলে কত টাকা করে জমাবেন, তারও লক্ষ্য ঠিক করতে পারবেন। তবে কিছু কৌশল মেনে চাইলে আপনিও কত টাকা করে জমাবেন, তা নিজেই নির্ধারণ করতে পারেন। তাতে আপনার লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে।
বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথমে তিন মাস চলতে যে খরচ হবে, তার সমপরিমাণ অর্থ জমান। যেমন এখন যদি আপনার প্রতি মাসে ৫০,০০০ টাকা খরচ হয় তাহলে (৫০,০০০ X ৩) দেড় লাখ টাকা জমাবেন। তবে কেউ কেউ তিন মাসের পরিবর্তে ছয় মাসের খরচের টাকা জমানোর পরামর্শও দিয়ে থাকেন।
বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরা কেন তিন মাসের খরচের টাকা জমানোর পরামর্শ দেন? কারণ, যেকোনো সময় চাকরি চলে যেতে পারে বা চাকরি ছেড়ে নতুন কিছু করার চিন্তা মাথায় আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই সময়ে যাতে সংসার খরচ চালাতে কোনো সমস্যা না হয়, তাই তিন মাসের খরচের সমান টাকা জমানোর কথা বলা হয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, এই তিন মাসে নতুন আরেকটি চাকরির ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন।
চাকরি চলে যাওয়া ছাড়াও পরিবারের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে, হাসপাতালে ভর্তি করাতে হতে পারে, বাসায় টিভি/ফ্রিজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে—এ ধরনের পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজনে এই জমানো টাকা কাজে আসবে। যদি তিন মাসের খরচের সমপরিমাণ অর্থ হাতে থাকে, তাহলে বাড়তি টেনশন করতে হবে না। মনে একটা সাহস থাকবে।
ইতিমধ্যে যদি এই পরিমাণ অর্থ বা তার বেশি জমা থাকে, তাহলে কত জমানোর লক্ষ্য স্থির করবেন? কীভাবে প্রতি মাসে টাকা জমাতে পারেন, তার কিছু নিয়ম আর্থিক বা বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরা দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে একটি হলো ৫০/৩০/২০ নিয়ম।
প্রতি মাসে যে আয় করেন, তা তিন ভাগে ভাগ করবেন। যেমন আপনি যদি এক লাখ টাকা মাসে আয় করেন, তাহলে ৫০ হাজার টাকা সংসারের দরকারি কাজে ব্যয় করবেন। ৩০ হাজার টাকা পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, বাসার দরকারি কোনো জিনিসপত্র কেনা এবং অন্যান্য কাজে ব্যয় করবেন। আর বাকি ২০ হাজার টাকা সঞ্চয় করবেন।
প্রতি মাসে টাকা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে ২০ হাজার টাকা আলাদা করে রাখবেন। আগে খরচ করে তারপর জমানোর চিন্তা পরিহার করতে হবে। কোনো মাসে যদি ৩০ হাজার টাকার পুরোটা খরচ না হয়, তাহলে যে টাকা হাতে থাকবে, তা ২০ হাজার টাকার সঙ্গে যোগ করে জমা করুন। এতে দেখা যাবে জমার পরিমাণ আরও দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে অবসরে যাওয়ার পর ভালো একটা অঙ্ক পাওয়া যাবে। এই টাকা দিয়ে অবসরকালীন সময়টা ভালো কাটবে।
অবসরে যাওয়ার পর আয় বন্ধ হয়ে গেলেও খরচ বন্ধ হবে না। ওই সময় যদি জমানো টাকা না থাকে, তাহলে কীভাবে চলবে নিজের খরচ? আর যদি কিছু জমানোও থাকে তাহলে ওই টাকা দিয়ে কি অবসরে যাওয়ার পর বাকি জীবন চলবে? অবসরে যাওয়ার আগে কত টাকা জমাতে হবে? বা একটু আগেই অবসরে যেতে চাইলে কীভাবে বুঝবেন অবসরে যেতে পারি? এ ধরনের বিভিন্ন প্রশ্ন আমাদের সামনে চলে আসে।
এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জমানো টাকা থেকে প্রথম বছর ৪ শতাংশ টাকা উত্তোলন করে যদি খরচ চলে, তাহলে বুঝবেন অবসরকালীন সঞ্চয় হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, আগে হিসাব করে দেখুন অবসরে যাওয়ার পর প্রতি মাসে কত খরচ হবে। যেহেতু এই সময়ে ছেলেমেয়ের পড়ালেখা শেষ হয়ে যাবে এবং তারা নিজেদের আয় দিয়ে নিজেরাই চলতে সক্ষম হবে, তাই তাদের জন্য আর খরচ করতে হবে না। শুধু আপনি এবং আপনার স্ত্রী/স্বামীর চলার জন্য মাসিক যে খরচ হবে, তা বিবেচনায় নিতে পারেন। এর সঙ্গে দরকারমতো আরও কিছু খরচ বিবেচনায় নিতে পারেন। এভাবে হিসাব করে দেখুন মাসিক কত টাকা লাগবে।
এভাবে মাসিক খরচের হিসাব বের করার পর এবার ১২ মাস দিয়ে গুণ করুন। যেমন আপনি যদি দেখেন মাসে ২৫ হাজার টাকা হলেই চলবে, তাহলে ১২ মাসে আসে (২৫,০০০ X ১২) ৩ লাখ টাকা। এবার ২৫ বছর দিয়ে গুণ করুন, তাহলে আসে (৩,০০,০০০ X ২৫) ৭৫ লাখ টাকা। এবার এই ৭৫ লাখ টাকার ৪% হলো ৩ লাখ টাকা, যা আপনার প্রথম ১২ মাসের খরচের টাকা। এই ৩ লাখ টাকা দিয়ে আপনি যে বছর অবসরে যাবেন, ওই বছর চলতে পারবেন।
আপনার মাসিক খরচ যদি কম বা বেশি হয়, তাহলে আপনার অবসরকালীন জমানো টাকার পরিমাণও কমবে বা বাড়বে। ১৯২৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই ৪% নিয়ম প্রকাশিত হয়েছে। তবে আপনি এখানে বলতে পারেন, প্রতিবছর যে ৩ লাখ টাকায় চলতে পারব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, প্রতিবছর যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে খরচ বাড়বেই।
এই গবেষণায় মূল্যস্ফীতির বিষয়টা বিবেচনায় নিয়েই করা হয়েছে। প্রতিবছর ৪% মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে। অবসরের পর প্রথম বছর আপনি জমানো টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা উত্তোলন করলেন। অবসরের দ্বিতীয় বছর ৩ লাখ ১২ হাজার টাকা উত্তোলন করবেন। এভাবে প্রতিবছর আপনি আগের বছরের ৪% বেশি উত্তোলন করবেন। তাহলে অবসরের সময় আপনার আর চলার খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
লেখক : স্মার্ট মানি হ্যাকস: সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সেরা প্ল্যান বইয়ের লেখক।