এত দিন বাংলাদেশিদের অনেকে দেশটিতে অন্যের নামে গোপনে ব্যবসা করে আসছিলেন। এখন সৌদি সরকার আইন পরিবর্তন করে সুযোগ দিয়েছে।
যেসব বাংলাদেশি সৌদি আরবে গিয়ে বছরের পর বছর অবৈধভাবে ব্যবসা করছেন, তাঁদের ব্যবসার বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার। কর্মী ভিসায় যাওয়া যেসব বাংলাদেশি এত দিন পরিচয় গোপন করে কোনো সৌদি নাগরিকের নামে ব্যবসা করতেন, তাঁদের ব্যবসাকে নিজ নামে নিবন্ধনের সুযোগ দিয়েছে সৌদি সরকার।
নিবন্ধনের জন্য ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন না করলে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। সেই শাস্তি নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে ‘বাণিজ্যিক গোপনীয়তাবিরোধী আইন’ সংশোধন করেছে দেশটির সরকার।
এই সুযোগ শুধু বাংলাদেশিদের জন্যই নয়, সৌদি আরবে বসবাসকারী সব বিদেশি নাগরিকদের জন্য। দেশটিতে অবৈধভাবে যেসব ভিনদেশি ব্যবসা করছেন, সেই ব্যবসাকে বৈধতা দিতে তিন মাস আগে সৌদি সরকার বাণিজ্যিক গোপনীয়তাবিরোধী আইন সংশোধন করেছে। সংশোধিত আইনে বিদেশি নাগরিকদের অবৈধ ব্যবসা কার্যক্রমের বৈধতার কথা বলা হয়েছে। আইনটি সংশোধনের ফলে এখন ব্যবসার তথ্য লুকানোর সুযোগ থাকবে না। এদিকে আইন সংশোধনের পর থেকেই দেশটির সব নাগরিকের কাছে তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দ্রুত নিবন্ধনের জন্য মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হচ্ছে।
সৌদি সরকার বলছে, ২৩ আগস্টের মধ্যে যাঁরা নিবন্ধন করবেন, তাঁরা সব ধরনের শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবেন। এই নিবন্ধনের মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকেরা তাঁদের ব্যবসা, বিনিয়োগ ও অন্যান্য লাভজনক আর্থিক কার্যক্রমের বৈধ পূর্ণ ও আংশিক মালিকানার সুযোগ পাবেন।
এই আইনের আওতায় সাজাপ্রাপ্ত বিদেশি নাগরিকদের সাজা ভোগ শেষে সৌদি আরব থেকে বহিষ্কার করা হবে। ভবিষ্যতে সৌদি আরবে তাঁদের আর প্রবেশের সুযোগ থাকবে না।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ যদি নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁকে সর্বোচ্চ ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ সৌদি রিয়াল জরিমানা করা হবে। অথবা পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পাশাপাশি সব ব্যবসা ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর আগের আইনে জরিমানার পরিমাণ ছিল মাত্র ৫০ হাজার রিয়াল। অথবা সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল। পাশাপাশি বাজেয়াপ্তের বিধান ছিল ব্যবসা ও সম্পদের ১০ শতাংশ। আইনটি সংশোধন করে এখন কঠোর করা হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই বাড়ানো হয়েছে শাস্তি।
সৌদি সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক সৌদি নাগরিককে দেখেছি নিজে বিনিয়োগ না করেও অর্ধেক মুনাফা নিয়ে যান। কারণ, ব্যবসা তাঁর নামে। কর্মী ভিসায় যাওয়া বাংলাদেশিদের জন্য ব্যবসা কিংবা বিনিয়োগ যেহেতু নিষিদ্ধ, এই সুযোগ নেন সৌদি নাগরিকেরা। সৌদি সরকার ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সমস্যা হবে যদি কর্মী ভিসায় যাওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যবসা ভিসায় স্থানান্তর করা না হয়। এ জন্য বাংলাদেশি দূতাবাসকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের পর সৌদি সরকার আইনজীবীর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করবে। কোনো ব্যবসায়ীর বার্ষিক লেনদেন (টার্নওভার) ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি রিয়ালের বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ মালিকানা তাঁর নামে রাখা হবে। বাকি ২৫ শতাংশ থাকবে সরকারের মালিকানায়। কোনো বিনিয়োগকারীর বার্ষিক লেনদেন যদি ২ কোটি রিয়ালের কম হয়, সেই অনুপাতে তাঁর মালিকানা নির্ধারিত হবে। নিবন্ধনের সময় শেষ হওয়ার পর কেউ যদি অবৈধ ব্যবসার খবর সরকারের কাছে পৌঁছে দেয়, তখন সন্ধানদাতাকে ওই ব্যবসার ৩০ শতাংশ মালিকানা দিয়ে ৭০ শতাংশ সরকার নিয়ে নেবে। সৌদি আরবে এখন ২৩ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন।
বাংলাদেশিসহ বিদেশি নাগরিক সৌদি আরবে কর্মী ভিসায় গিয়ে গোপনে অন্য ব্যবসা করছেন—সরকারের কাছে এই খবর অনেক আগে থেকেই রয়েছে। কিন্তু এত বছর সৌদি সরকার ততটা কঠোর হয়নি। কিন্তু এবার এত কঠোর হওয়ার মূল কারণ, দেশটি ‘ভিশন ২০৩০’ নামে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যেখানে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ অবারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার। সে জন্য গোপনে যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের মূল স্রোতে আনতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সৌদি ন্যাশনাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের অপারেশন ম্যানেজার জালাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী ভিসায় সৌদি আরব গিয়ে অনেকে টাকাপয়সা জমিয়ে সৌদি নাগরিকের নামে ব্যবসা শুরু করেন। এসব ব্যবসার মধ্যে রয়েছে নির্মাণ ব্যবসা, সুপারমার্কেট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, গাড়ি, জনশক্তি রপ্তানি। যখন ব্যবসা বেশ বড় ও লাভজনক হয়, তখন ওই সৌদি নাগরিক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে বের করে দেন। যেহেতু নিজের নামে ব্যবসার নিবন্ধন নেই, তাই আইনিভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না বাংলাদেশিরা। এখন যদি অবৈধ ব্যবসাকে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সে ব্যবসায় নিরাপত্তা থাকবে।