সরকারি বিধিনিষেধের কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যারের বিক্রি কমে গেছে। তৈজসপত্রের বেচাবিক্রি বন্ধ।
করোনার সংক্রমণ রোধে চলমান সরকারি বিধিনিষেধের বাইরে রয়েছে নির্মাণ খাত। তবে দোকানপাট বন্ধ থাকায় নির্মাণকাজের সহযোগী সিরামিক খাতের ব্যবসায় ধস নেমেছে। বিধিনিষেধের মধ্যে সিরামিক টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যারের বিক্রি তা–ও কিছুটা হলেও তৈজসপত্রের বেচাবিক্রি নেমেছে শূন্যের কোটায়। অন্যদিকে কারখানায় উৎপাদন চলায় গুদামে জমছে পণ্যের স্তূপ।
সিরামিক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, লকডাউন দীর্ঘমেয়াদি হলে উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। কারণ বিক্রি না থাকলে বেশি দিন উৎপাদন চালানোর সক্ষমতা থাকবে না। অন্যদিকে দোকানপাট বন্ধ থাকায় খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাঁদের অনেকের জন্যই আগামী মাসে দোকানভাড়া ও কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া কঠিন হবে।
রাজধানীর হাতিরপুলে সিরামিক টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যারের বড় বাজার। এখানে সিরামিক খাতের সব কটি প্রতিষ্ঠানেরই ডিলার রয়েছে। আছে বহু খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। চাহিদা বাড়তে থাকায় অলিগলিতেও টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যারের দোকান ছড়িয়ে পড়েছে।
হাতিরপুলে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, চলমান লকডাউনের কারণে অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ থাকলেও ১৫-২০টি দোকানের ঝাঁপ (শাটার) একটু খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। তার মধ্যে কয়েকটিতে দু-একজন করে ক্রেতাও রয়েছেন। তবে চিরচেনা ব্যস্ততা নেই। পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক ও ভ্যানচালকেরাও অলস সময় কাটাচ্ছেন।
সিরামিক এজেন্সি নামের দোকানের ঝাঁপ একটু খোলা দেখে ভেতরে ঢুকলাম। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মো. ইব্রাহিম মুঠোফোনে একজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলছিলেন। লকডাউনেও দোকান খোলা কেন জানতে চাইলে বললেন, ‘পরিচিত একজন কাস্টমার টাইলস কিনতে আসবেন। তাই দোকান খুলেছি।’ তাহলে ব্যবসা তো হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না ভাই। ব্যবসা খুব খারাপ। চলতি মাসে দোকানের ভাড়ায় উঠবে না। বেতন পাব কি না, সেটি বুঝতে পারছি না।’
হাতিরপুলের কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী জানালেন, নির্মাণকাজের কারণে সিরামিক টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যারের চাহিদা সারা বছরই থাকে। তবে ঈদুল ফিতরের আগে বেচাবিক্রি অন্যান্য সময়ের তুলনায় চাঙা হয়। গতবার করোনার কারণে ভালো বিক্রি হয়নি। চলতি বছরও বিধিনিষেধের কারণে ঈদের ব্যবসা আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
মুকিত টাইলস গ্যালারির স্বত্বাধিকারী মো. শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুরিয়ারসহ শিল্পপণ্যবাহী গাড়ির চলাচল করায় ঢাকার বাইরে থেকে দু–একটি ক্রয়াদেশ আসছে। তা ছাড়া হঠাৎ দু-একজন ক্রেতা টুকটাক কিছু পণ্য কিনতে আসেন। তবে এই বেচাবিক্রি দিয়ে আমাদের দুই দোকান ও গোডাউনের ভাড়া এবং ১৪ জন কর্মীর বেতনও উঠবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার কারণে গতবার যে লোকসান হয়েছিল, তা সামলে ওঠার আগেই নতুন করে ধাক্কা এল। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট পাঁচ-ছয় ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হলেও আমরা টিকে যেতাম।’
বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন সিরামিক পণ্যের বাজার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ বাজার স্থানীয় উৎপাদকদের দখলে। দেশের অভ্যন্তরে সবচেয়ে বড় বাজার টাইলসের, প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার। স্যানিটারিওয়্যারের বাজার ৯০০ কোটি আর তৈজসপত্রের বাজারের আকার প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। খাতটিতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকা।
লকডাউনের কারণে সিরামিকের তৈজসপত্র উৎপাদনের কারখানা ফার সিরামিকস উৎপাদন সক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। এমন তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের আগের ১০-১৫ দিন ভালো বিক্রি হয়। সে জন্য রোজার শুরুর দিকে সব বিক্রেতা পণ্য স্টক করেন। এবার সেটি হয়নি। দেখা যাক, সরকার সবকিছু খুলে দিলে বিক্রিবাট্টা হয় কি না। সেই আশাতে আমরা উৎপাদন চালু রেখেছি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গতবারের লোকসান এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এখন নতুন করে আবার ধাক্কা আসায় ব্যবসার ক্ষতি পোষাতে অনেক সময় লেগে যাবে।
সিরামিকের উপখাত তিনটি—তৈজসপত্র, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার। এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য দেশে কারখানার সংখ্যা ৬৮টি। তার মধ্যে ২০টি তৈজসপত্র, ৩০টি টাইলসের ও ১৮টি স্যানিটারিওয়্যারের কারখানা। করোনার প্রথম ধাক্কার পরও গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশীয় টাইলসের বিক্রি বেড়েছে ১ শতাংশ। অন্যদিকে দেশীয় তৈজসপত্রের বিক্রি ৫ দশমিক ৬৭ এবং স্যানিটারিওয়্যারের ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ কমেছে।
জানতে চাইলে চায়না-বাংলা সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিসিএমইএর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনের মধ্যেও আমরা কারখানা চালু রেখেছি। দোকানপাট বন্ধ থাকায় ডিলারেরা পণ্য নিচ্ছে না। সে কারণে গুদামে পণ্যের স্তূপ জমছে। তবে বেশি দিন দোকানপাট বন্ধ থাকলে উৎপাদন চালানো সম্ভব না। তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাসসংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়। তা ছাড়া কাঁচামাল আমদানিতে জাহাজভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে ব্যাংকঋণের সুদ মওকুফ করলে আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের জন্য খুব সুবিধা হতো।’