লিচুর ফলনে বিপর্যয়, লোকসানে চাষিরা

পাবনায় আগে প্রতি মৌসুমে প্রায় ৪১ হাজার মেট্রিক টন লিচু উৎপাদিত হলেও এবার তার অর্ধেক হয়েছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।

সাধারণত বৈশাখের মাঝামাঝি থেকে আষাঢ় পর্যন্ত পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলা হয়ে ওঠে লিচুময়। এ সময় উপজেলাটির ছোট-বড় যে রাস্তা দিয়েই চলবেন, দুই পাশেই চোখে পড়বে টুকটুকে লাল লিচুবাগান। কিন্তু চলতি মৌসুমে ঈশ্বরদীতে সেই চিরচেনা রূপ নেই। জেলার অন্য উপজেলাগুলোতেও একই অবস্থা। কারণ, হঠাৎ খরায় লিচুর মুকুল ও গুটি ঝরে গেছে। এর ওপর সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে বোঁটা পচে ঝরে পড়েছে আস্ত লিচু। ফলে এবার লিচুর ফলনে বিপর্যয় ঘটেছে। লিচুচাষিদের ধারণা, উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কম হয়েছে।

তবে ফলন কম হওয়ায় বাজারে চড়া দামে লিচু বিক্রি হচ্ছে। লিচুচাষিরা বলছেন, ফলন কম হওয়ার কারণেই চলতি মৌসুমে বাজারে লিচুর দাম বেশি।

লিচু বেচেই আমাগের জীবন-সংসার চলে। ইবার একদিকি করোনা, আরদিকি লিচু নাই। হগল (সকল) চাষিকই ইবার পথে বসতি হবিনি।’
আমিরুল ইসলাম, ঈশ্বরদীর লিচুচাষি

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাবনার ৯ উপজেলায় মোট ৪ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে ঈশ্বরদী উপজেলায়। এ ছাড়া জেলা সদরে ৬২৫ ও চাটমোহর উপজেলায় ২৭০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়।

আগের হিসাব অনুযায়ী এ জেলায় বছরে গড়ে প্রায় ৪০ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদিত হয়ে থাকে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে চলতি মৌসুমে সব মিলিয়ে ২০ হাজার মেট্রিক টন লিচু উৎপাদিত হতে পারে। এতে মোট বিক্রির পরিমাণ ৩৫০ কোটি টাকার মতো কম হবে।

পাবনা জেলা সদরের দাপুনিয়া, রাজাপুর ও তিনগাছা; ঈশ্বরদী উপজেলার জয়নগর, বাঘৈল, রূপপুর, দাশুদিয়া, বক্তারপুর, আওতাপাড়া, লক্ষ্মীকুণ্ডা, বাবুইচড়া, মিরকামারি, ভারইমারি এবং চাটমোহর উপজেলার গুনাইগাছা ও রামচন্দ্রপুর প্রভৃতি এলাকায়ই লিচুর আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। এসব এলাকার প্রায় ১০ হাজার কৃষক লিচু চাষের ওপর নির্ভর করে চলেন। চলতি মৌসুমে ফলন বিপর্যয়ের কারণে তাঁরা সবাই বিপাকে পড়েছেন।

সরেজমিনে গত সোমবার ঈশ্বরদীর অন্যতম লিচুর মোকাম আওতাপাড়া হাটে গিয়ে দেখা গেছে, বেচাকেনা আগের মতো জমজমাট নয়। সরবরাহ খুবই কম, বাইরের পাইকারও নগণ্য। তাই বাগানমালিক ও কৃষকেরা দাম বেশি হাঁকাচ্ছেন। প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। কয়েকজন ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত সপ্তাহে প্রতি হাজার লিচু ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাগানে লিচু যত কমছে, দাম তত বাড়ছে। কিন্তু বেশি দামে লিচু বিক্রি হলেও উৎপাদন খরচ উঠছে না বলে দাবি কৃষক ও বাগানমালিকদের।

আওতাপাড়া গ্রামের লিচুচাষি গফুর মিয়া জানান, তিনি ২০ বিঘা জমিতে লিচুর আবাদ করেন। আগে প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করতেন। এ বছর মাত্র ৩ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেছেন। বাগানে যা লিচু আছে, তা বিক্রি করে আরও এক লাখ টাকার মতো পেতে পারেন। ফলে এবার বড় লোকসানের আশঙ্কা তাঁর।

উপজেলার মিরকামারি গ্রামের লিচুচাষি আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘লিচু বেচেই আমাগের জীবন-সংসার চলে। ইবার একদিকি করোনা, আরদিকি লিচু নাই। হগল (সকল) চাষিকই ইবার পথে বসতি হবিনি।’

আওতাপাড়া হাটে ইসমাইল হোসেন নামের এক পাইকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি ঈশ্বরদী থেকে লিচু কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন। প্রতিবছর এ সময়ে প্রতিদিন তিন থেকে চার ট্রাক পর্যন্ত লিচু কিনতেন। কিন্তু এবার লিচুর ফলন কম, দাম বেশি। আবার ট্রাকভাড়াও বেড়ে গেছে। তাই অল্প পরিমাণে লিচু কিনছেন।

জানতে চাইলে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবহাওয়া বৈরী হওয়ার কারণেই চলতি বছর লিচুর ফলন কম হয়েছে। যখন ফুল আসছিল, তখন হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। ফলে অধিকাংশ গাছেই মুকুল কম হয়েছে। তবে মুকুল যা বের হয়েছে, তাতে ভালো লিচু হয়েছে। বাজারে দামও ভালো আছে। ফলে কৃষকের ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে যাবে বলে আশা করছি।’