পিপিপিতে কেউ বিনিয়োগ করলে এত দিন যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো, নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেসব সুবিধা আর ঢালাও মিলবে না।
কর অবকাশসহ নানা সুবিধা থাকার পরও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে বা পিপিপিতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এ কারণে গত এক যুগেও পিপিপির আওতায় দেশে বড় কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় পিপিপি থেকে ঢালাও প্রণোদনা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। ঢালাও কর অবকাশ সুবিধার বদলে যাচাই-বাছাই করে এ সুবিধা দেওয়া হবে। পিপিপি কর্তৃপক্ষের নির্বাহী বোর্ডের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পিপিপি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জাতীয় মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, বন্দর, টানেলসহ মোট ১৪ ধরনের প্রকল্পে কর অবকাশ সুবিধা রয়েছে। কোনো বিনিয়োগকারী এই ১৪ ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে তাঁকে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি এসব প্রকল্পের জন্য পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া আছে। কিন্তু সর্বশেষ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে বেসরকারি বিনিয়োগকারীকে এই সুবিধা ঢালাও দেওয়া যাবে না। যেসব আবেদন যৌক্তিক মনে হবে, তাঁদেরই এ সুবিধা দেওয়া হবে। যাঁদের আবেদন যৌক্তিক মনে হবে না, তাঁরা এ সুবিধা পাবেন না। তবে যাঁরা এরই মধ্যে এ কর অবকাশসহ নানা সুবিধা পেয়ে গেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে তা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের পর এ সুবিধা দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে পিপিপি কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চলমান প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রণোদনার সুবিধা চালু থাকবে। কিন্তু নতুন করে পিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর অবকাশসহ নানা প্রণোদনা দেওয়া হবে যাচাই-বাছাইয়ের পর।
তবে এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, পিপিপিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবশ্যই উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিতে হবে। প্রণোদনা না দিলে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পিপিপি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছিল, সেটি অর্জিত হবে না।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন,বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে অবকাঠামো খাতে আট শতাংশ বিনিয়োগ হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এখন হচ্ছে জিডিপির মাত্র তিন শতাংশ। এ বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবশ্যই উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিতে হবে। প্রণোদনা না দিলে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পিপিপি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছিল, সেটি অর্জিত হবে না।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, পিপিপিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে। বেসরকারি খাত ঝুঁকি নিয়েই সেখানে বিনিয়োগ করে। যদি লাভজনক না হয়, তাহলে কেউ পিপিপিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না। বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতেই প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রণোদনা না দেওয়া হলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবেন না। এমনিতেই যেগুলো আকর্ষণীয় প্রকল্প, সেগুলো সরকার নিজের টাকায় বাস্তবায়ন করে। আর যেগুলো অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, সেগুলো পিপিপি মডেলে করে। এ কারণেও কেউ পিপিপিতে বিনিয়োগে আসতে চায় না।
চলমান প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রণোদনার সুবিধা চালু থাকবে। কিন্তু নতুন করে পিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর অবকাশসহ নানা প্রণোদনা দেওয়া হবে যাচাই-বাছাইয়ের পর।ফারুক আহমেদ, মহাপরিচালক, পিপিপি কর্তৃপক্ষ
পিপিপি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পিপিপি মডেলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। এ ছাড়া ঢাকা বাইপাস সড়ক, মোংলা বন্দরের জেটি নির্মাণের কাজ চলমান। পিপিপিতে বিনিয়োগের জন্য এখন ৭০টির বেশি প্রকল্প অপেক্ষমাণ। সরকার কেন পিপিপির প্রণোদনা সুবিধার লাগাম টানতে চায় জানতে চাইলে পিপিপি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার রাজস্ব আদায় বাড়াতে চায়। কিন্তু কর অবকাশসহ অন্যান্য সুবিধার কারণে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এ কারণে কর অবকাশের পরিধি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে চাইছে সরকার।
এদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৩০ শতাংশ অর্থে পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসছে সরকার। ২০১৮ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এডিপির আওতায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে প্রতিবছর যে টাকা দেওয়া হয়, সেখান থেকে ৩০ শতাংশ অর্থে পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু পিপিপি কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, ২০১৮ সালে ততটা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। কারণ, ধর্ম মন্ত্রণালয় বা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কীভাবে ৩০ শতাংশ টাকায় পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এ কারণে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে পিপিপি কর্তৃপক্ষ।
যদি লাভজনক না হয়, তাহলে কেউ পিপিপিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না। বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতেই প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রণোদনা না দেওয়া হলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবেন না।আবুল কাশেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার
পিপিপি অফিস বলছে, এখন থেকে তারা কোনো মন্ত্রণালয়কে পিপিপিতে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগের বিষয়ে কড়াকড়ি হবে না। কেউ চাইলে মানতে পারে। কেউ চাইলে না-ও মানতে পারে। এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে না।
দেশে প্রথমবারের মতো ২০০৯ সালে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপি মডেল চালু করা হয়। অথচ নানা জটিলতায় এ মডেল এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি। যদিও পিপিপি কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা জানান, জনবল সংকটের কারণে তাঁদের কাজে গতি আসছে না। মাত্র ৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে চলছে সংস্থাটি। ২০১৮ সালে বিভিন্ন শ্রেণিতে ৭১ জন জনবল চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হলেও এখনো অনুমোদন মেলেনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে প্রথমবারের মতো ২০০৯ সালে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপি মডেল চালু করে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু আমলাতান্ত্রিকসহ নানা জটিলতায় দেশে এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি পিপিপি মডেল।