অর্থনীতিতে নোবেল

যত বেশি শিক্ষা, তত বেশি আয়

পড়াশোনার সময়ের সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক আছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করলেই আয় বাড়বে, ব্যাপারটা এমন সরলরৈখিক নয়।

ডেভিড কার্ড
ডেভিড কার্ড জন্ম ১৯৫৬, গুয়েলফ, কানাডা কর্মস্থল ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরস্কারের কারণ শ্রম অর্থনীতিতে অভিজ্ঞতালব্ধ অবদানের কারণে পুরস্কারের পরিমাণ ৫০ শতাংশ

‘পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’—ছেলেবেলায় এই প্রবাদ বাঙালিমাত্রই শুনেছেন। পড়াশোনায় গাফিলতি করলে অভিভাবকেরা শিশুদের এই প্রবাদের কথা মনে করিয়ে দিতেন। বিষয়টি হচ্ছে, ভালো পড়াশোনা করলে মানুষ ভালো চাকরি করতে পারে, সেটা বোঝানোর জন্যই এই প্রবাদ। ২০২১ সালে অর্থনীতিতে যে তিনজন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তাঁদের মধ্যে জোশুয়া ডি অ্যাংরিস্ট ১৯৯১ সালে এ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি সেখানে দেখেছেন, মানুষের শিক্ষার মেয়াদের সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক আছে।

সেই গবেষণায় অ্যাংরিস্ট দেখান, যাঁরা ১২ বছর পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের আয় ১১ বছর পড়াশোনা করা মানুষের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। আর যাঁরা ১৬ বছর পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের আয় ৬৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে, এই সম্পর্ক কি কার্য-কারণ সংক্রান্ত। এ নিয়েই কাজ করার জন্যই নোবেল পেয়েছেন জোশুয়া ডি অ্যাংরিস্ট। সঙ্গে আছেন আরও দুজন।

অর্থনীতিতে অবদানের জন্য ২০২১ সালে তিন অর্থনীতিবিদ একত্রে আলফ্রেড নোবেল স্মারক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁরা যথাক্রমে ডেভিড কার্ড, জোশুয়া ডি অ্যাংরিস্ট ও গুইডো ডব্লিউ ইমবেনস।

ডেভিড কার্ড (১৯৫৬) একজন শ্রম অর্থনীতিবিদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। জোশুয়া অ্যাংরিস্ট (১৯৬০) জন্মসূত্রে ইসরায়েলি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অর্থনীতির অধ্যাপক। গুইডো উইলহেলমস ইমবেনস (১৯৬৩) জন্মসূত্রে ওলন্দাজ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিষয়ক পত্রিকা ইকনোমেট্রিকস-এর বর্তমান সম্পাদক। এর আগে অধ্যাপনা করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে।

সুইডিশ একাডেমি জানিয়েছে, ডেভিড কার্ডকে পুরস্কৃত করা হয়েছে ‘শ্রম অর্থনীতিতে তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ অবদানের কারণে’। বাকি দুই অর্থনীতিবিদকে ‘কজাল রিলেশনশিপ’ বা কার্য-কারণসংক্রান্ত বিশ্লেষণের বিষয়ে পদ্ধতিগত অবদানের জন্য’ নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ‘কজাল রিলেশনশিপ’ বলতে অর্থনীতিতে কার্যকারণের সেই সম্পর্ক বিন্যাসকে বোঝানো হয়, যেখানে কার্য ও কারণের মধ্যে ভিত্তি এবং উপাদানগত সম্পর্ক বিরাজ করে।

জোশুয়া ডি অ্যাংরিস্ট
জোশুয়া ডি অ্যাংরিস্ট । জন্ম ১৯৬০, কলম্বাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্মস্থল ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) পুরস্কারের কারণ কার্যকারণ–সংক্রান্ত বিশ্লেষণে পদ্ধতিগত অবদানের জন্য পুরস্কারের পরিমাণ ২৫ শতাংশ

পুরস্কারের ঘোষণায় বলা হয়, সামাজিক বিজ্ঞানের অনেক বড় বড় প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ কার্য-কারণ সম্পর্ক নিরূপণে গলদঘর্ম হয়। যেমন অভিবাসন মানুষের বেতন/মজুরি বা কাজের ধরনে কী প্রভাব ফেলে। শিক্ষার মেয়াদ মানুষের ভবিষ্যৎ আয়ে কী প্রভাব ফেলে? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, এসব বিচার করার ক্ষেত্রে গবেষকদের হাতে তুলনামূলক মানদণ্ড থাকে না। অভিবাসন বেশি না হলে বা মানুষ পড়াশোনা বেশি দিন না চালিয়ে গেলে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা আমরা জানি না। এবারের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদেরা দেখিয়েছেন, অভিজ্ঞতাভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব। আকস্মিক ঘটনা বা নীতিগত পরিবর্তনের কারণে কিছু মানুষের জীবনে ভিন্ন কিছু ঘটছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের মধ্যেই এই উত্তরের চাবিকাঠি, ঠিক যেমন ওষুধের পরীক্ষা করা হয়। ওষুধের ক্ষেত্রে যা ঘটে তা হলো, একই ধরনের লক্ষণযুক্ত রোগীদের মধ্যে এক দলকে নির্দিষ্ট ওষুধ দেওয়া হয় এবং বাকিদের তা দেওয়া হয় না। তখন দেখা হয়, সেই ওষুধের প্রভাব কী।

এক বছরের জন্য যদি শিক্ষার্থীদের কোনো গোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার মেয়াদ এক বছরের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বৃদ্ধি করা হয় (এবং অন্য গোষ্ঠীগুলোকে এর বাইরে রাখা হয়), তাহলে দেখা যাবে, সেই বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত প্রত্যেক পড়ুয়ার কাছে এই ব্যবস্থার প্রভাব সমানভাবে পড়ছে না। কিছু পড়ুয়া তাতে উপকৃত হলেও অনেকেই হবে না। এই না-হওয়াদের দল পুরো গোষ্ঠীর পরিচয় বহন করতে পারে না। নিরীক্ষার ‘ফল’ হিসেবে শুধু তাদের অভিজ্ঞতাই তুলে ধরা যায় না। এ বিষয়ে পদ্ধতিগত সমস্যার সমাধান করছেন অ্যাংরিস্ট ও ইমবেনস।

পুরস্কারের ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, এই যে অ্যাংরিস্ট ও ইমবেনস দেখালেন, শিক্ষার মেয়াদ এক বছর বাধ্যতামূলকভাবে বৃদ্ধি করা হলে যে তার প্রভাব সবার ওপর সমানভাবে পড়ে না, তা থেকে কী উপসংহার টানা যায়। এঁরা দুজন দেখালেন, কীভাবে সুনির্দিষ্ট উপসংহার টানতে হবে।

অন্যদিকে ডেভিড কার্ড ১৯৯০-এর দশকে ন্যূনতম মজুরি বিষয়ে অর্থনীতির বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত ধারণার সমালোচনা করে নজর কাড়েন। পরে অভিবাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি গবেষণা করেন। বিভিন্ন অভিবাসী গোষ্ঠীর ওপরে নিরীক্ষা চালিয়ে কার্ড দেখান, অভিবাসনের ফলে কোনো দেশের অর্থনীতি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন সময়ের অভিবাসন বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, এর ফলে দুই দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাঁর বক্তব্য আমেরিকার শ্রমবাজারে বাইরের শ্রমের অনুপ্রবেশের পক্ষে কথা বলে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অভিবাসনবিরোধী স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসেন, তার সারবত্তা নেই।

গুইডো ডব্লিউ ইমবেনস
গুইডো ডব্লিউ ইমবেনস জন্ম ১৯৬৩, নেদারল্যান্ডস কর্মস্থল স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরস্কারের কারণ কার্যকারণ–সংক্রান্ত বিশ্লেষণে পদ্ধতিগত অবদানের জন্য পুরস্কারের পরিমাণ ২৫ শতাংশ

কার্ড আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নির্ণয়ে অবদান রেখেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করলেই যে কর্মসংস্থানের হার কমে যাবে, এমনটা নয়। নোবেল পুরস্কার ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘এখন আমরা জানি, কোনো দেশে নতুন অভিবাসনের কারণে সেখানকার নাগরিকেরা যেমন উপকৃত হতে পারে, তেমনি সেই দেশে যাঁরা আগে অভিবাসী হিসেবে এসেছেন, তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’ আরও বলা হয়েছে, ‘আমরা এ-ও বুঝতে পেরেছি, বিদ্যালয়ের সম্পদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে শ্রমবাজারে প্রবেশের সম্পর্ক আছে।’

সুইডিশ একাডেমির পুরস্কার কমিটির প্রধান পিটার ফ্রেডেরিকসন জানিয়েছেন, সমাজের অন্তস্তলের সমস্যা নিয়ে কার্ডের গবেষণা এবং অর্থনীতির পদ্ধতিগত আলোচনার ক্ষেত্রে অ্যাংরিস্ট ও ইমবেনসের কাজ জ্ঞানজগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।

পুরস্কার ভাগ হবে

সাম্প্রতিক অতীতে ২০১৯ সালেও তিনজন একত্রে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এ ক্ষেত্রে পুরস্কারের অর্থ ভাগ করে দেওয়া হয়। এই পুরস্কারের মূল্যমান ১১ লাখ ডলার। মোট পুরস্কারের অর্ধেক পাবেন ডেভিড কার্ড। বাকি অর্ধেক জোশুয়া ডি অ্যাংরিস্ট ও গুইডো ডব্লিউ ইমবেনসের মধ্যে সমান হারে ভাগ হয়ে যাবে। সঙ্গে তাঁরা সোনার মেডেল পাবেন।