বিসিকের প্রকল্প

মুদ্রণশিল্প পার্ক নিয়েও তালগোল

বিসিক কর্মকর্তাদের অদূরদর্শিতা ও খামখেয়ালির কারণে মুদ্রণশিল্প পার্কের নির্মাণকাজ আরও পিছিয়েছে।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সাড়ে পাঁচ হাজার মুদ্রণ কারখানাকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে চেয়েছিল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এ লক্ষ্যে মুন্সিগঞ্জে একটি মুদ্রণশিল্প পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই কাজে তালগোল পাকিয়ে বসেছে সংস্থাটি। মুদ্রণশিল্প পার্কের জন্য প্রথমে যে জায়গা অনুমোদন করা হয়েছিল, ছয় বছর পর সেখান থেকে সরে এসেছে বিসিক। নতুন জায়গায় জমি ঠিক করেছে তারা। কর্মকর্তাদের এ ধরনের অদূরদর্শিতা ও খামখেয়ালির কারণে মুদ্রণশিল্প পার্কের খরচ এখন প্রায় ১০০ শতাংশ বাড়ছে।

এর আগে রাজধানীর নিমতলী থেকে রাসায়নিক শিল্পপার্কও বাইরে সরিয়ে নেওয়া নিয়েও একই কাণ্ড ঘটিয়েছিল বিসিক। সে ক্ষেত্রে তো খরচ বাড়িয়েছে আট গুণ। অতীত থেকে শিক্ষা না নিয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল সংস্থাটি। এতে একদিকে সরকারের খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে সঠিক সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারছে না সংস্থাটি। ফলে ব্যবসায়ীদেরও প্রকল্পের সুফল পাওয়া বিলম্বিত হচ্ছে।

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার মুদ্রণ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বড় এক হাজার, মাঝারি দুই হাজার ও ক্ষুদ্র কারখানা আড়াই হাজার। সার্বিকভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ মুদ্রণ কারখানাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। স্থানীয় পরিবেশের ওপর এসব কারখানার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। তাই কারখানাগুলোকে পরিকল্পিতভাবে এক জায়গায় নিয়ে যেতে ২০১৬ সালে ১৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি মুদ্রণশিল্প পার্ক গড়ে তোলার প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। এ জন্য মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বড়বত্তার এলাকায় ৪৩ একর জায়গা নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই বিসিক মুদ্রণশিল্প পার্ক প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল।

সর্বোচ্চ তিন হাজার মুদ্রণ কারখানা রয়েছে ঢাকায়। এসব কারখানা রাজধানীর আরামবাগ, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, কাঁটাবন, নীলক্ষেতসহ পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, বাবুবাজার, বাংলাবাজার, ইসলামপুর ও লালবাগ প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে।

ছয় বছর পরে বিসিক এখন বলছে, মাত্র ৪৩ একর জমিতে শিল্পপার্ক করলে তাতে সাড়ে পাঁচ হাজার কারখানার সংকুলান হবে। আগের পরিকল্পনায় পুরোপুরি গলদ ছিল। যেমন, মুদ্রণশিল্পে বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর একেকটির জন্যই ৫ থেকে ১০ একর জমি লাগবে। তা ছাড়া সিরাজদিখানের বড়বত্তায় যেখানে মুদ্রণশিল্পের জন্য জমি ঠিক করা হয়েছিল তার বড় অংশই খাসজমি। সেখানে এখন ৩০টি বাড়ি রয়েছে। এসব বাড়িতে ৯০টি পাকা ও আধা পাকা ঘর আছে। ৪০টি ভূমিহীন পরিবারও বসবাস করছে দীর্ঘদিন ধরে। তাদের উচ্ছেদ করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

২০০৮ সাল থেকেই শুনে আসছি মুদ্রণশিল্পের জন্য একটি শিল্পপার্ক হচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা শুধু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আলোর মুখ দেখেনি। সাইদুর রহমান
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি

বিসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, তখন যাঁরা মুদ্রণশিল্পের জন্য ওই জমি ঠিক করেছিলেন, তাঁরা ঠিক করেননি। তাই নতুন করে সিরাজদিখান উপজেলার খারসুর এলাকায় ৪০০ একর জমি চাওয়া হয়েছে। তবে শিল্প মন্ত্রণালয় জমি দিয়েছে ১০০ একর। নতুন জায়গায় এখন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২৭৫ কোটি টাকা। মানে খরচ বাড়ছে ৯৯ শতাংশ। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নেওয়ার প্রস্তাব করেছে বিসিক। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পর্ষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক নিজাম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিরাজদিখান উপজেলার বড়বত্তা এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। মুদ্রণশিল্প পার্কের জন্য নতুন করে ওই উপজেলার খারসুর এলাকায় ১০০ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, জমি অধিগ্রহণে জটিলতার কারণে কাজ এগোয়নি। জমিসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে। এবার দ্রুত কাজ শুরু করা যাবে। প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে রাজধানীর নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের প্রাণহানির পর ওই বছর পুরান ঢাকা থেকে সব রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিসিক। কিন্তু আট বছর পর কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক শিল্পকারখানা নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সংস্থাটি। সেটি পরিবর্তন করে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে নেওয়া হয়। পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বলা হয়, কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জায়গায় এতগুলো কারখানা স্থানান্তর সম্ভব নয়। তাই মুন্সিগঞ্জে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে ২০১ কোটি টাকার ওই প্রকল্পের খরচ বেড়ে ১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। বিসিকের কর্মকর্তাদের অদূরদর্শিতার দরুন সেই প্রকল্পের খরচ বাড়ে আট গুণ।

বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতি বলছে, মুদ্রণশিল্প প্রধানত স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য ও সেবা তৈরি করছে। যার মধ্যে বই, সাময়িক পত্রিকা, প্যাড, খাতা, স্টিকার, লিফলেট, ডায়েরি, ভিউকার্ড, ভিজিটিং কার্ড, কার্টুন ইত্যাদি রয়েছে। এই শিল্পে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার বার্ষিক আর্থিক মূল্য দেড় হাজার কোটি টাকা। এই খাতের রপ্তানি আয় বছরে ১৫০ কোটি টাকা। মুদ্রণশিল্পে প্রত্যক্ষভাবে দেড় লাখ ও পরোক্ষভাবে প্রায় তিন লাখ মানুষ জড়িত রয়েছেন।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মুদ্রণশিল্প নির্ধারিত জায়গায় স্থানান্তরের জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়। মুদ্রণশিল্প পার্ক নিয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও বিসিকের সমঝোতা স্মারক সই করে ২০১৩ সালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৮ সাল থেকেই শুনে আসছি মুদ্রণশিল্পের জন্য একটি শিল্পপার্ক হচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা শুধু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আলোর মুখ দেখেনি। ট্যানারিশিল্পকে ঢাকা থেকে সরাতে লাঠিপেটা পর্যন্ত করতে হয়েছে। অথচ আমরা নিজেরাই ঢাকা থেকে চলে যেতে চাই। কিন্তু কবে নাগাদ আমাদের জন্য জমি তৈরি হবে, আমরা জানি না।’

সাইদুর রহমান আরও বলেন, ‘জায়গার অভাবে আমরা এই শিল্পের সম্প্রসারণ করতে পারছি না। শিল্পপার্ক করতে পারলে আমাদের আর দেশের বাইর থেকে পাঠ্যপুস্তক আমদানি করতে হবে না।’