আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতার আওতা বাড়ানো হচ্ছে। তবে জনপ্রতি ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা রাখারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাত বছর আগে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা যখন একলাফে প্রায় দ্বিগুণ করা হলো, তখন গরিব বয়স্ক নারী-পুরুষ এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের সরকার মাসে ৪০০ টাকা করে ভাতা দিত। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাঁদের ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে করা হলো ৫০০ টাকা। এরপর টানা ছয় বছর ধরে আর এই ভাতা বাড়ানো হয়নি। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরেও তা না বাড়ানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির এক বৈঠকে এই ভাতার পরিমাণ ৫০০ থেকে ১০০ বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করার সুপারিশ করেছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সায় দেয়নি।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অঙ্কের হিসাবে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সার্বিকভাবে বরাদ্দ বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে উপকারভোগীর সংখ্যাও। নতুন অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ দেখানো হবে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয় ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় সাত বছর আগের ৫০০ টাকার মূল্য এখন ৩৫০ টাকার মতো। তাই ভাতার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি পুরো সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সংস্কার প্রয়োজন ।সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে অনিয়ম রয়েছে, তা দূর করার ব্যাপারেও বাজেটে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। তবে নতুন করে ১১ লাখ ব্যক্তিকে এই খাতের আওতায় আনার উদ্যোগ থাকবে সরকারের। দুই বছর আগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১১২ উপজেলায় ভাতা দেওয়া হতো। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাড়ানো হয় আরও ১৫০ উপজেলায়। ফলে বর্তমানে ২৬২টি উপজেলায় বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এবারে আরও ১০০ উপজেলায় এই কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে। তাতে দেশের ৬৪ জেলার ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার আওতায় মোট উপজেলার সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৬২। প্রসঙ্গত, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়ার এই কার্যক্রম শুরু হয়।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের বয়স্ক ভাতা পাওয়া একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫০০ টাকা
করে ভাতা পাচ্ছি। জিনিসপত্রের এখন যে দাম, তাতে ৩০ দিনের মধ্যে ভাতার টাকায় এলে এক দিনই চলা যায়। ভাতা কমপক্ষে দুই হাজার টাকা করা উচিত।’
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৫৭ লাখ ব্যক্তিকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরে ১১ লাখ বাড়ানো হলে মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ৬৮ লাখে উন্নীত হবে। এ ছাড়া বর্তমানে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা পান ২৪ লাখ ৭৫ হাজার জন।
চলতি অর্থবছরে ১২০টি বিষয় নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাত সাজিয়েছে অর্থ বিভাগ। অন্য যেসব কর্মসূচি রয়েছে—বেদে, রূপান্তরিত মানুষ ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি; প্রতিবন্ধী ভাতা; মাতৃত্বকালীন ভাতা; বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ও সরকারি কর্মচারীদের পেনশন। এগুলোতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে পেনশনের অংশই প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বর্তমানে ২০ লাখ ৮ হাজার অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। প্রায় দুই লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন ২০ হাজার টাকা করে।
এদিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে অর্থ বিভাগের তৈরি করা তালিকায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ‘খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসৃজন কর্মসূচি’ উপশিরোনামের আওতায় টিআর, জিআর, ভিজিডি, ভিজিএফ ইত্যাদি সাতটি বিষয়ে ১৫ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এ ছাড়া নগদ ও খাদ্যসহায়তা–সংক্রান্ত ১৭টি, ঋণসহায়তার ৪টি, বিশেষ সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর ১২টি, বিভিন্ন তহবিল ও কর্মসূচি ৯টি, উন্নয়ন কর্মসূচি ৩৫টি এবং ১৭টি নতুন উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অধিকতর কার্যকর করতে ২০১৫ সালে সরকার পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মাধ্যমে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএসএস) প্রণয়ন করে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এনএসএসএসের একটি মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে ৪৬ শতাংশ ভাতাভোগী উপযুক্ত না হয়েও তা নিচ্ছেন বলে তথ্য ওঠে আসে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, কর্মসূচিটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তার মধ্যে আনা। সেটি হচ্ছে না। কারণ, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় সাত বছর আগের ৫০০ টাকার মূল্য এখন ৩৫০ টাকার মতো। তাই ভাতার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি পুরো সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সংস্কার দরকার।