সাড়ে পাঁচ বছর পর আগামী ২৮ ও ২৯ নভেম্বর বিনিয়োগ সম্মেলন হচ্ছে। যদিও আগের সম্মেলনে পাওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিনিয়োগ মেলেনি।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ কেমন এবং এখানে উদ্যোক্তাদের কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তা জানান দিতে সাড়ে পাঁচ বছর পর আবারও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে সরকার। আগামী ২৮ ও ২৯ নভেম্বর রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল র্যাডিসনে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
সম্মেলনের আয়োজক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত যে ভেঙে পড়েনি, তা বিশ্বকে দেখাতে চায় সরকার। আজ রোববার সংবাদ সম্মেলন করে বিনিয়োগ সম্মেলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে। তবে সরকারের এই উদ্যোগে বিদেশি বিনিয়োগ কতটা গতি পায়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, সাড়ে পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিনিয়োগ আসেনি।
জানতে চাইলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আমরা সরাসরিই বিনিয়োগ সম্মেলন করব। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ টানতে যেসব সংস্কার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের সামনে সেগুলো তুলে ধরা হবে।’
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ টানতে যেসব সংস্কার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের সামনে সেগুলো তুলে ধরা হবে।সিরাজুল ইসলাম, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বিডা
এবারের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন, নেদারল্যান্ডস, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ভারত, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার সরকারি প্রতিনিধি ও বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকসহ (এআইআইবি) বৈশ্বিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। স্থানীয় নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা তো যোগ দেবেনই।
এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, যেখানে রয়েছে অসীম বিনিয়োগের সম্ভাবনা’। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে হোটেল র্যাডিসনে বিনিয়োগ সম্মেলন হয়েছিল। সাধারণত দুই বছর পরপর এই সম্মেলন আয়োজনের রীতি থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং করোনা সংক্রমণের কারণে বিগত সাড়ে পাঁচ বছর তা করতে পারেনি সরকার। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করতে আগে বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করত অধুনালুপ্ত বিনিয়োগ বোর্ড। ২০১৬ সালের শেষের দিকে বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারীকরণ কমিশনকে একীভূত করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) গঠনের পর নতুন সংস্থারই কাজটি করার কথা ছিল। দেরিতে হলেও সংস্থাটি সেই কাজ করতে মাঠে নেমেছে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ এখনো আগের জায়গাতেই পড়ে আছে। এ দেশে গড় এফডিআই এখনো মাত্র ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে ১৫ হাজার কোটি ডলারের বেশি এফডিআই পায়। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জমির অপ্রতুলতা, সরকারি দপ্তরের সেবা নিতে হয়রানি, এক দরজায় সব সেবা না পাওয়া, আইনি দুর্বলতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে আসছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
বিডার তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৬ সালের বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা জানিয়েছিল ভারতের বড় দুই শিল্প গ্রুপ রিলায়েন্স ও আদানি। ওই অর্থ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। আদানি গ্রুপ এ দেশে বন্দর, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), টার্মিনাল, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা বলেছিল। আর রিলায়েন্স গ্রুপ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
ওই সম্মেলনে চীন, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের উদ্যোক্তারা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ঘোষণা না দিলেও বড় বিনিয়োগ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। এ ছাড়া অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী ওই সম্মেলনে যোগ দিতে না পারলেও শিগগিরই বাংলাদেশে এসে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব প্রতিশ্রুতির কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। শুধু রিলায়েন্স গ্রুপ কুমিল্লার মেঘনাঘাটে এত বছর পর একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে যাচ্ছে। অবশ্য এখনো কাজ শুরু করেনি।
বিনিয়োগকারীদের জন্য বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানিসহ সব ধরনের সুবিধা রয়েছে। বিনিয়োগ সম্মেলনে আমরা এসব চিত্র তুলে ধরব।শেখ ইউসুফ হারুন, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বেজা
এবারের সম্মেলনকে অন্যবারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। কারণ, করোনার মধ্যেও জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত করার সম্মতি দিয়েছে। আগামী ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। তখন শুল্কমুক্তসহ অনেক সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। তাই এখন থেকেই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছে সরকার। এদিকে বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়েছে। এর মানে, এখানে ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি হচ্ছে। এটাকে কাজে লাগাতে চায় সরকার।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘সরকার সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল এখন দৃশ্যমান। সেখানে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানিসহ সব ধরনের সুবিধা রয়েছে। বিনিয়োগ সম্মেলনে আমরা এসব চিত্র তুলে ধরব।’
আলোচ্যসূচিতে যা থাকছে—
বিডার তথ্য অনুযায়ী, এবারের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম দিনে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলোসহ বিনিয়োগের পরিবেশ ও বিনিয়োগ সক্ষমতার সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হবে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো বাংলাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার চলমান পরিকল্পনা। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরা হবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে। এ ছাড়া বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হবে প্রথম দিন।
দ্বিতীয় দিনে পোশাক, বস্ত্রসহ চামড়া ও চামড়াজাত খাতের পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) সম্ভাবনা, পুঁজিবাজার, পরিবহন, ওষুধশিল্প, কৃষি ব্যবসায় এবং ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরা হবে। বিডার এক কর্মকর্তা জানান, পোশাক খাতের বিকল্প হিসেবে চামড়াশিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে সম্মেলনে।