যুক্তরাজ্যে তখন আর্থিক সংকট চলছে। সরকারের আয় নেই। সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু। যুদ্ধবিগ্রহ তো লেগেই ছিল। এর মধ্যে ১৭২০ সালে শেয়ারবাজার ধসের কারণে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। এই ধস ইতিহাসে সাউথ সি বাবল নামে পরিচিত। ঠিক এ রকম এক পরিস্থিতির ফল হচ্ছে জাতীয় বাজেট।
শুরুতে কথাটা ছিল বুজেট। এটি একটি ফরাসি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে মানিব্যাগ বা টাকার থলি। এই টাকার থলিকেই বাজেটে রূপ দেওয়া হয়েছিল ১৭৩৩ সালে। তখন দেশটির রাজা দ্বিতীয় জর্জ। যুক্তরাজ্যের আর্থিক সংকট তখন চরমে। সরকারের আয় আসত মূলত সম্পদ কর থেকে। যাঁদের সম্পদ আছে, অনেক ভূসম্পত্তির মালিক, তাঁদের কাছ থেকেই কর নেওয়া হতো। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কর বাড়ানো হবে এ রকম একটি কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল। আবার কর বিলুপ্তির দাবিও ছিল। তখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন রবার্ট ওয়ালপুল। নানা মহল থেকে করসংক্রান্ত যত দাবি বা প্রস্তাব তিনি পেতেন, সব একটা বুজেট বা মানিব্যাগে রেখে দিতেন। তারপর যখন আনুষ্ঠানিকভাবে কর প্রস্তাব উত্থাপনের সময় এল, তিনি মানিব্যাগ থেকে সব বের করে একটা প্রস্তাব তৈরি করে তা পার্লামেন্টে উত্থাপন করলেন। সেটাই ছিল বিশ্বের প্রথম বাজেট।
বাজেটের জনক হিসেবে রবার্ট ওয়ালপুল ইতিহাসে স্থান করে নিলেও বাজেট দেওয়াটা তাঁর জন্য রাজনৈতিকভাবে সুখকর কিছু হয়নি। রবার্ট ওয়ালপুল মূলত আবগারি শুল্ক বসিয়েছিলেন তামাক ও মদের ওপর। এতে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিক বিরোধীরাও আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ফলে তিনি প্রস্তাবটি তুলে নিতে চেয়েছিলেন। তবে এর আগেই পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে তিনি হেরে যান। ফলে নতুন করে নির্বাচন দিতে হয়। সেই নির্বাচনে অবশ্য তাঁর দল ঠিকই জয়লাভ করে এবং তিনি ১৭৪২ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে থাকেন।
১৭৩৩ সালের আগে মূলত কর বা শুল্ক আদায় হতো ধনীদের কাছ থেকে। সম্পদ করই ছিল রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় খাত। রবার্ট ওয়ালপুল সম্পদশালীদের সম্পদ কর কমিয়ে সেই করের বোঝা প্রথমবারের মতো ভোক্তাদের ওপর আরোপ করেছিলেন। অর্থাৎ এখনো যে ভোক্তারা কর দেন, তারও জনক ওয়ালপুল। পাশাপাশি কর আদায়ে আমলা বা প্রশাসনের হস্তক্ষেপের ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। নিয়ম করেছিলেন মদ ও সিগারেটের ওপর যে কর দিতে হবে, তা বন্দর থেকে আমদানি পর্যায়ে আদায় করা হবে না, বরং ওয়্যারহাউস থেকে বিক্রির সময় আদায় করা হবে। এর পরেই কর আদায়ে প্রশাসনে থাকা অর্থাৎ শুল্ক কর্মকর্তাদের ভূমিকা বেড়েছে।
আবার বাজেট কথাটার উৎপত্তি নিয়ে আরেকটি কথাও প্রচলিত আছে। অক্সফোর্ড ইংলিশ অভিধানে বলা আছে, ষোড়শ শতাব্দীতে ‘টু ওপেন ওয়ান্স বাজেট’ বলে একটা কথা প্রচলিত ছিল। এর অর্থ গোপন বা সন্দেহজনক কিছু বের করে দেওয়া। সুতরাং বাজেট বিষয়টির সঙ্গে গোপন কিছুর সংযোগ আছে। এ কারণেই বাজেটের গোপনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তারপরও বাজেট ফাঁসের আছে নানা কাহিনি।
বাজেট ফাঁস হওয়ায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন এডওয়ার্ড জন ডালটন। তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। ডালটন ১৯৪৫ সালের ২৭ জুলাই থেকে ১৯৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ঘটনাটি ১৯৪৭ সালের, তখনো তিনি বাজেট বক্তৃতা শেষ করেননি। কিন্তু এর আগেই দ্য স্টার পত্রিকার সন্ধ্যাকালীন সংস্করণে বাজেট হুবহু ছাপা হয়ে যায়। এই ঘটনায় তিনি বিরোধীদের ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পদত্যাগ করেছিলেন।
১৯৩৬ সালে ঘটেছিল মজার আরেক ঘটনা। ব্রিটেনের এক মন্ত্রী জেমস হেনরি থমাস শেয়ার ব্যবসায়ীদের কাছে বাজেটের তথ্য ফাঁস করে দেওয়ায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি গলফ খেলার সময় ‘টি আপ’ বলে চিৎকার দিয়েছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে চায়ের ওপর শুল্ক বাড়ছে। এ নিয়ে হইচই হলে তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে রীতিমতো তদন্ত হয়েছিল, যাতে তিনি বাজেট ফাঁসের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
আবার ১৯৯৬ সালে ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের অর্থমন্ত্রী কেনেথ ক্লার্কের বাজেট আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডেইলি মিরর বাজেট আগাম পেয়েও তা প্রকাশ করেনি। ফলে খুব ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাঁকে। ডেইলি মিরর-এর সম্পাদক পিয়ার্স মরগ্যান তখন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘আমরা সাধারণত সরকারকে বিব্রত করার সুযোগ তেমন ছাড়ি না, বিশেষ করে এ রকম একটি স্কুপ পাওয়ার পরও। কিন্তু এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর অর্থনৈতিক নথি অর্থমন্ত্রীকে ফেরত দেওয়া আমাদের জাতীয় কর্তব্য।’
তবে গণমাধ্যমের জন্য ভালো কাজটি করতে গিয়ে একবার বিপদও দেখা দিয়েছিল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন (২০০৭-১০) সংসদে উপস্থাপনের আগে বাজেটের তথ্য সাংবাদিকদের জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে গণমাধ্যম বাজেট রিপোর্ট ভালোভাবে করতে পারে। একবার বিপত্তিটি ঘটিয়েছিল ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা। ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক সাংবাদিক প্রথম পাতার ছবি তুলে টুইটারে প্রকাশ করে দেন। অথচ তখনো বাজেট বক্তৃতা শুরুই হয়নি। এ জন্য ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হয়।
রবার্ট ওয়ালপুল মানিব্যাগে বাজেট প্রস্তাব রেখে দিতেন। পরে অর্থমন্ত্রীরা একটি চামড়ার ব্যাগে করে বক্তৃতা নিয়ে আসতেন। তবে ১৮৬০ সালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন চামড়ার থলির পরিবর্তে কাঠের বক্স ব্যবহার শুরু করেন। কারণ, তাঁর বাজেট বক্তৃতা এতটাই দীর্ঘ ছিল যে ছোট থলিতে আঁটানো যায়নি। ইতিহাসের দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতার মালিক তিনি। তাঁর বক্তৃতাটি ছিল ৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের। দীর্ঘ বক্তৃতা শেষে অবশ্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
সেই কাঠের বাক্স চলে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। পরে জেমস কালাহান ১৯৬৫ সালে ব্রিফকেস বদল করেন। তিনি যে ব্রিফকেসটি ব্যবহার করেন, সেটির রং ছিল ব্রাউন বা বাদামি। সেটিকে অবশ্য ঠাট্টা করে বলা হয় ‘ভালগার ব্রাউন ভ্যালিস’। সেটি আবার পরিবর্তন করেন গর্ডন ব্রাউন, ১৯৯৭ সালে। মজার ঘটনা হলো, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গ্লাডস্টোনের সেই কাঠের বক্সটি আবার ব্যবহার করেছিলেন অ্যালিস্ট্যায়ার ডাওলিং ও জর্জ অসবর্ণ। এরপর ব্যবহার করা যায়নি। এতটাই খারাপ অবস্থা ছিল বক্সটির।
বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থা ব্রিটিশদের অনুসরণ করেই তৈরি। মূলত এই উপমহাদেশের সবাই একই রীতি মেনে চলে। সবাই একইভাবে বাজেট তৈরি ও উপস্থাপন করে। এমনকি বাজেট বহনকারী ব্রিফকেস নিয়েও একই ধরনের ঐতিহ্য বজায় রাখা হয়েছে। ভারতের বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ অবশ্য ব্রিফকেসের ধারা পাল্টিয়েছেন। তিনি এখন লাল কাপড় মোড়ানো একটা খাতা নিয়ে আসেন। এর কারণ হিসেবে বলেছিলেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার কাটাতেই এই ব্যবস্থা।
অনেক দেশই বাজেট দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঐতিহ্য মেনে চলে। কানাডার অর্থমন্ত্রী নতুন জুতা পরে বাজেট উপস্থাপন করেন। নেদারল্যান্ডস অনুসরণ করে ব্রিটিশদের। ১৯৪৭ সাল থেকে বিশেষ এক ব্রিফকেসে বাজেট নিয়ে আসেন দেশটির অর্থমন্ত্রীরা। বাংলাদেশেও ব্রিফকেস ব্যবহৃত হয়। তবে বছরের পর বছর একই ব্রিফকেস ব্যবহারের ঐতিহ্য এখানে নেই।
উপমহাদেশের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন জেমস উইলসন। রানির প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে এসেছিলেন ১৮৫৯ সালে। সিপাহি বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়ে গেছে। সরাসরি ব্রিটিশদের শাসন শুরু। সিপাহি বিদ্রোহের অবসানের তিন বছর পর দেওয়া হয়েছিল সেই বাজেট। জেমস উইলসন ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল উপমহাদেশের প্রথম বাজেটটি পেশ করেছিলেন। স্কটিশ এই ব্যবসায়ী ছিলেন ইন্ডিয়া কাউন্সিলের ফিন্যান্স মেম্বার। তার অবশ্য আরও পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন চার্টার্ড ব্যাংক ও বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা। পরে চার্টার্ড ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলে নামকরণ হয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন ভারতে একটি করকাঠামো তৈরি, কাগুজে নোট চালু এবং আর্থিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কাজে। কাজ শুরুও করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত জেমস উইলসনের ভারত সফর তাঁর জন্য মোটেই ভালো হয়নি। ১৯৬০ সালেই তিনি কলকাতার গরমে অতিষ্ঠ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ১৯৬০ সালের আগস্টে কলকাতাতেই মারা যান। তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল কলকাতার মল্লিক বাজারের সমাধিতে। একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেও তাঁকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছে, তা ২০০৭ সাল পর্যন্ত ছিল প্রায় অজানা। সিপি ভাটিয়া আয়কর বিভাগের একজন যুগ্ম কমিশনার। তিনি ভারতের করব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জেমস উইলসনের কবরস্থানের সন্ধান পেয়েছিলেন। এরপর তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়।
ব্রিটিশ ভারতের শেষ বাজেট দিয়েছিলেন লিয়াকত আলী খান। উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তাতে যোগ দিয়েছে মুসলিম লীগ। লিয়াকত আলী খান তখন হলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন ১৯৪৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। লিয়াকত আলী খানের সেই বাজেট ‘পুওর ম্যান বাজেট’ বা গরিবদের বাজেট বলা হয়। সেই বাজেটে লবণের ওপর কর সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তিশ্রেণির ন্যূনতম আয়করের সীমা দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা হয়। যাঁদের আয় এক লাখ টাকার বেশি, তাঁদের ওপর ২৫ শতাংশ হারে বিশেষ আয়কর আরোপ করাও হয় সেই বাজেটে।
দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮-৪৯ অর্থবছরের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন মালিক গুলাম মোহাম্মদ। এই পাকিস্তান আমলেই মুসলিম লীগ সরকারের সময় অর্থবছর গণনা এপ্রিল-মার্চ থেকে সরে এসে জুলাই-জুন করা হয়। সেই ধারা বাংলাদেশে রয়ে গেছে। তবে ভারত এখনো এপ্রিল-মার্চ ধরে অর্থবছর বিবেচনা করে। স্বাধীন ভারতে প্রথম বাজেট দেন অর্থমন্ত্রী আর কে শানমুখম শেট্টি, ১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর।
বাংলাদেশের প্রথম অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। এখন পর্যন্ত তিনিই বাজেট দেওয়া একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রাজনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ জন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা দেশের ৫০টি বাজেট দিলেন।
সংবিধানে সরাসরি বাজেট কথাটির উল্লেখ নেই, বরং একটি আর্থিক বিবৃতি উপস্থাপনের কথা বলা আছে। পাশাপাশি আছে অর্থবিল পাসের কথা। বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি বিষয়ে সংবিধানের ৮৭ (১)-এ বলা আছে, প্রত্যেক অর্থবছরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি সংসদে উপস্থাপিত হবে। একেই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি বলা হবে। অর্থবিলের সংজ্ঞা আছে সংবিধানের ৮১(১)-এ। সেখানে বলা আছে, অর্থবিলে থাকবে কোনো কর আরোপ, নিয়ন্ত্রণ, রদবদল, মওকুফ বা রহিত করা; সরকার কর্তৃক ঋণ গ্রহণ বা কোনো গ্যারান্টি দান কিংবা সরকারের আর্থিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কিত আইন সংশোধন; সংযুক্ত তহবিলের রক্ষণাবেক্ষণ, অনুরূপ তহবিলে অর্থ প্রদান বা অনুরূপ তহবিল হতে অর্থ দান বা নির্দিষ্টকরণ; সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায় আরোপ কিংবা অনুরূপ কোনো দায় রদবদল বা বিলোপ ইত্যাদি। কর আরোপ সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদের কোনো আইনের দ্বারা বা কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো কর আরোপ বা সংগ্রহ করা যাবে না। আর সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুসারে, করারোপ বলতে সাধারণ, স্থানীয় বা বিশেষ যেকোনো কর, অভিকর, শুল্ক বা প্রবেশকরের আরোপ বোঝায়। মূলত, অভিকর স্থানীয় সরকার কর্তৃক আরোপিত হয়, শুল্ক ধার্য করা হয় দ্রব্য বা সেবার ওপর এবং প্রবেশকর কোনো দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য প্রদেয় কর।
বাজেটে রাজস্ব প্রস্তাব কার্যকরসংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন আছে, যেটি ১৯৩১ সালের। প্রভিশনাল কালেকশন অব ট্যাক্সেস আইনে কখন কোন কর প্রস্তাব কার্যকর হবে, তা বলা থাকে। সাধারণত আমদানি ও সম্পূরক শুল্কসহ বিভিন্ন কর প্রস্তাব বাজেট পেশের সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়, যাতে কেউ মজুত বা অপব্যবহার না করতে পারে। সুতরাং বাজেট পেশের সঙ্গেই এই শুল্ক বা কর প্রস্তাব কার্যকর হয়ে যায়।
লাতিন শব্দ ‘ট্যাক্সার’ থেকে ইংরেজি ‘ট্যাক্স’ শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ মূল্য আদায় করা। আর অভিধানে কর শব্দের অর্থ হলো রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে আদায়কৃত আর্থিক অবদান। বাংলাদেশ ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে করারোপ পদ্ধতি পেয়েছে।
বাংলাপিডিয়ায় বলা আছে, উপমহাদেশে ভূমি বা তার উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কর প্রাচীনকাল থেকে চালু ছিল। বৈদিক যুগের (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০-১৫০০ অব্দ) প্রথম দিকে রাজশক্তি সুগঠিত ছিল না এবং করারোপ ছিল সাময়িক ও ঐচ্ছিক। বলি শব্দটির উদ্ভব হয়েছে দেবতাদের কৃপা লাভের জন্য স্বেচ্ছায় কিছু উৎসর্গ করার অর্থে, যা পরবর্তী সময়ে স্বেচ্ছায় রাজাকে কমবেশি প্রদত্ত উপহার ও কর বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। বৈদিক যুগের শেষ দিকে করারোপের প্রকৃতি বদলে যায় এবং রাজাকে ‘প্রজাদের খাদক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সম্ভবত রাজা ও তাঁর অনুচরদের জনসাধারণ কর্তৃক খাদ্যপণ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা প্রথা থেকে এ ধারণা উদ্ভূত হয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে সর্বোচ্চ সমাহর্তা (রাজস্ব কর্মকর্তা) সাতটি স্থান পর্যবেক্ষণ করতেন এবং সেখান থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। এ সাতটি স্থান হলো দুর্গবেষ্টিত নগরী, গ্রামাঞ্চল, খনি, সেচ, বন, পশুপালন এবং বাণিজ্যপথ। এগুলোর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ভূমির ওপর প্রযোজ্য কতিপয় করের, যেমন স্বত্ব (রাজ ভূমিজাত পণ্য থেকে সংগৃহীত রাজস্ব), ভাগ (ব্যক্তিগত ভূমিজাত পণ্যের এক-ষষ্ঠাংশ), বলি (উপহার বা চাহিদা হিসেবে রাজপ্রাপ্তি), কর (ফল ও বৃক্ষ থেকে রাজাকে প্রদত্ত পর্যাবৃত্ত কর) ইত্যাদি।
ভারতের মুসলিম শাসনামলে (১২০৬-১৭৫৭) প্রাচীনকালের ভূমির ওপর করারোপের পদ্ধতির তেমন পরিবর্তন হয়নি, তবে করের পরিমাণ কখনো উৎপাদিত পণ্যের এক-তৃতীয়াংশে, কখনোবা অর্ধাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনামলেও (১৭৫৭-১৯৪৭) ভারতীয় প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ভারতের সনাতনী ভূমিকর ব্যবস্থা বলবৎ রাখা হয়। ব্রিটিশরা জমিদার সৃষ্টি করে তাঁদের মাধ্যমে প্রত্যেক প্রজার কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করে। সাধারণত উৎপাদিত পণ্যের ভিত্তিতে কর নির্ধারণ করা হতো, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর আদায় ছিল দমনমূলক এবং অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্যের অর্ধেকের বেশি কর হিসেবে আদায় করা হতো। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের মাধ্যমে বাংলায় জমিদারদের জন্য কর নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ১১ ভাগের ১ ভাগ। ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল হলেও বাংলাদেশের বর্তমান ভূমি রাজস্ব পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ থেকে।
আয়কর এই অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশরাই। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় ব্যয় বেড়েছিল অনেক। ইংরেজদের কোষাগারে প্রচণ্ড অর্থসংকট দেখা দেয়। সেই ঘাটতি পূরণেই ১৮৬০ সালে প্রথম আয়কর চালু করা হয়। জেমস উইলসনের কথা আগেই বলা হয়েছে। জেমস উইলসনই আইনসভায় আয়কর বিল উত্থাপন করেছিলেন। সেই আয়কর আইনে ২০০ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়করমুক্ত ছিল। তখন ২০০ থেকে ৪৯৯ টাকা পর্যন্ত ২ শতাংশ এবং এর বেশি আয় হলে ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হতো। আর কৃষি খাতের আয় ৬০০ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত ছিল।
প্রথম আলোতেই জাহাঙ্গীর শাহ এ নিয়ে লিখেছিলেন যে চালুর পরের পাঁচ বছর আয়কর আইনটি বলবৎ ছিল। তবে আইনটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে দুই বছরের জন্য আইনটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু ১৮৬৭ সালে এসে আবার বাজেট ঘাটতিতে পড়ে তৎকালীন সরকার। তখন বাধ্য হয়ে ভারতের আইনসভা আবার আরেকটি আয়কর আইন করে। তখন করের হার হ্রাস করে ১ দশমিক ৬০ শতাংশ করা হয়। আর ৫০০ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত করা হয়। এই আইনে কৃষি খাতের আয়কে করমুক্ত রাখা হয়। আইনটিও ১৮৭৩ সালে বাতিল করা হয়। ১৮৭৭-৭৮ সালে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে আবারও আইনটি বলবৎ করা হয়। এই সময়ে ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নিলে কর দিতে হতো। পরে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত নানা ধরনের সংশোধনের পর ওই আয়কর আইনে কর আদায় করা হতো। তবে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ইংরেজরা নতুন আয়কর আইনটি ব্যাপকভাবে সংশোধন করে। করের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
তবে রাজস্বসংক্রান্ত সব কটি আইনকে এক করে ১৯২২ সালে প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ আয়কর আইন প্রণয়ন করে ইংরেজ সরকার। এই সময়ে একটি রাজস্ব বোর্ডও গঠন করা হয়। কর কমিশনার, সহকারী কর কমিশনার, আয়কর কর্মকর্তা—এসব পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯২২ সালের আইনটি দিয়ে স্বাধীনতার পরও এ দেশে চালু ছিল। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রপতির এক আদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠন করে সরকার। এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে নতুন আয়কর অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সেটিও নানা পরিবর্তনে জটিল হয়ে পড়েছে। এখন সরকার নতুন করে আবার আয়কর আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
আকবর আলি খান তাঁর বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি বইয়ে লিখেছেন, ‘সাংবিধানিক দিক থেকে বাজেটের ভিত্তি হলো নো ট্যাক্সেশন উইদাউট রিপ্রেজেনটেশন, জনপ্রতিনিধিদের সম্মতি ছাড়া কোনো কর আদায় করা যাবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের সম্মতির প্রয়োজনীয়তা ইংল্যান্ডে প্রথম স্বীকৃত হয় দ্বাদশ শতকে ম্যাগনা কার্টা বিদ্রোহের সময়। এই মতবাদ যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ইংরেজদের মধ্যে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৬০-এর দশকে বোস্টন নগরীতে বিদ্রোহী মার্কিন নাগরিকেরা এই মতবাদের ভিত্তিতে নতুন করারোপের বিরোধিতা করেন। ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধের খরচ বহন করার জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন বোধ করেন। তাই এশিয়া থেকে আমদানি করা চায়ের ওপর তিনি অতিরিক্ত কর বসান। বোস্টনের ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধিদের সম্মতি না নেওয়ায় এই কর দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং আমদানি করা চায়ের বাক্স সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। এখানেই শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাসংগ্রাম।’
অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান ব্যয় বিশ্লেষণ, অর্থের ইতিহাস ও তত্ত্ব এবং স্থায়িত্ব নীতির জটিলতাবিষয়ক গবেষণার জন্য ১৯৭৬ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন। তিনি জনগণের সম্মতিতে কর আরোপ নিয়ে বহু বিখ্যাত কথাটিকেই ঘুরিয়ে অন্যভাবে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ইনফ্লেশন ইজ ট্যাক্সেশন উইদাউট লেজিসলেশন’। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি হলো আইন ছাড়া কর আরোপ করা। তবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান আরও কঠোরভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ে বলেছিলেন। তাঁর ভাষায়, মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ছিনতাইকারীর মতো হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মতো ভয়ংকর এবং খুনির মতোই প্রাণঘাতী।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন, অব্যবস্থাপনায় থাকা একটি জাতি নিরাময়ের জন্য দুটি কাজ করে। একটি হলো মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায়, অন্যটি যুদ্ধ শুরু করে। উভয়ই একটি অস্থায়ী সমৃদ্ধি নিয়ে আসে; আবার উভয়ই স্থায়ী ধ্বংস ডেকে আনে। উভয়ই কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাবাদীদের আশ্রয়স্থল। মার্কিন অর্থনীতিবিদ থমাস সোয়েল বলেছিলেন, প্রকাশ্যে কর না বাড়িয়ে জনগণের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার একটি উপায় হলো মূল্যস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি হলো সবচেয়ে সর্বজনীন কর।
জন মেনার্ড কেইনস বলেছিলেন, ক্রমাগত বা অব্যাহত মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে সরকার তাদের নাগরিকদের সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গোপনে, সবার অগোচরে বাজেয়াপ্ত করতে পারে।
এদুয়ার্দো গালেআনো উরুগুয়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক। তিনি অবশ্য মজা করে বলেছিলেন, ‘সর্বোত্তম ভাষা হলো নীরবতা। আমরা শব্দের এক ভয়ানক মূল্যস্ফীতির সময়ে বাস করি, যা টাকার স্ফীতির চেয়েও অনেক খারাপ।’ আমাদের মন্ত্রীরা যেভাবে বাংলাদেশকে সুইজারল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর বানাচ্ছেন, তিন বেলা মাংস খাওয়ার উপযুক্ত করছেন, ইউরোপের সমান ক্রয়ক্ষমতার গল্প বলছেন, তাতে এদুয়ার্দো গালেআনোর কথাটি এখানে উল্লেখ করাই যায়।
তাত্ত্বিকভাবে মূল্যস্তর অব্যাহত বেড়ে যাওয়াই মূল্যস্ফীতি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন মূল্যস্ফীতি হয়? এর দুটি তত্ত্ব রয়েছে। একটি হচ্ছে অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব, অন্যটি বাড়তি চাহিদা তত্ত্ব। সহজ ভাষায়, বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়লে বিভিন্ন পণ্যের দামও বাড়ে। কারণ, তাতে পণ্য আগের মতোই থাকে, কিন্তু মানুষের হাতে টাকা যায় বেড়ে। এতে যে দাম বাড়ে, তাকেই মূল্যস্ফীতি বলা যায়। বাড়তি চাহিদা তত্ত্বটি একটু অন্য রকম। যেমন টাকা ও পণ্য আগের মতোই আছে। উৎপাদনও বাড়ল না। কিন্তু হয়তো মানুষ বেড়ে গেল, কিংবা যারা আছে তারা একটু বেশি কিনতে চাইল। এতে চাহিদাও বাড়ল। তাতেও পণ্যের দাম বাড়তে পারে। কারণ হিসেবেও মূল্যস্ফীতি দুই ধরনের হয়। যেমন: চাহিদা বাড়লে যে মূল্যস্ফীতি হয়, তাকে বলে চাহিদাজনিত বা ডিমান্ড পুল মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ পণ্যের সরবরাহ কম থাকলেও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। আরেকটি হচ্ছে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত বা কস্ট পুশ মূল্যস্ফীতি। অনেক সময় যেসব উপকরণ দিয়ে পণ্য উৎপাদন করা হয়, সেসব উপকরণের দাম বাড়লে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এতে পণ্যের দাম বাড়ে এবং মূল্যস্ফীতি ঘটে।
তৃতীয় শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। ইতিহাস বলে, সেটাই বিশ্বে প্রথম মূল্যস্ফীতির ঘটনা। মুদ্রার বদলে পেপার নোট চালু করার পর চীনে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি ঘটে চতুর্দশ শতাব্দীতে। আর ইউরোপসহ অন্যত্র উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিজ্ঞতা ষোড়শ শতাব্দীতে। মার্কিন ও ফরাসি বিপ্লবের সময় প্রচুর মুদ্রা ধ্বংস করা হয়েছিল। এরও পরিণতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির দিক থেকে ভালো ছিল উনিশ শতকটি। মূল্যস্ফীতি তো ছিলই না, বরং ছিল ডিফ্লেশন। নেপোলিয়নের যুদ্ধের সেই ১৮১৫ থেকে ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরুর আগপর্যন্ত মূল্যস্ফীতি তেমন ছিল না বললেই চলে। উনিশ শতকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় কেবল যুক্তরাষ্ট্রে, গৃহযুদ্ধের কারণে। যুদ্ধের পর পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।
মূল্যস্ফীতির শতক হচ্ছে বিংশ শতাব্দী। এই শতকে মানুষ জীবনযাপনের মান যেমন বেড়েছে, নিকৃষ্টতম মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের ভোগান্তিও বেড়েছে। যেমন অতি মূল্যস্ফীতি দেখা গিয়েছিল জার্মানিতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯২২ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে জার্মানির মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল ৩২২ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরির পরিস্থিতি ছিল আরও খারাপ। ১৯৪৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৪৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল ১৯০০০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিদিন বেড়েছে ১৯ শতাংশ হারে। কয়েক বছর আগেও জিম্বাবুয়েতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৭০০ শতাংশ।
পুরোনো অনেক ছবিও আছে। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে শিশুরা মার্কের নোট নিয়ে খেলত, লোকজন নোট নিয়ে দেয়াল সাজাত। ঠেলাগাড়িতে করে অর্থ নিয়ে যাওয়ার সেই ছবি এখনো গুগলে খুঁজলেই পাওয়া যায়। মূল্যস্ফীতি পুরোনো দুটি গল্প আবার বলা যায়। যেমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ পকেটভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যেত, আর ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে আসত বাসায়। এখন কিন্তু মানুষ ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যায়, আর পকেটভর্তি বাজার নিয়ে বাসায় ফেরে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গল্পটি এ রকম—প্রশ্ন: রুবল, ডলার ও পাউন্ডের পারস্পরিক বিনিময় হার কত? উত্তর: এক পাউন্ড রুবল=এক ডলার। এক চোর বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে যাচ্ছিল, পথে পড়ল ডাকাত। ডাকাতেরা সব টাকা রাস্তায় ফেলে বস্তাটি নিয়ে পালাল। কারণ, বস্তার দামটাই বেশি।
জন মাথাই ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় অর্থমন্ত্রী। ১৯৪৯-৫০ অর্থবছরের জন্য তিনি যে বাজেট দিয়েছিলেন, সেটি বিখ্যাত হয়ে আছে তাঁর বক্তব্যের জন্য। তিনি পুরো বাজেটটি পড়েননি। সেটি লিখিত আকারে সবাইকে দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি কেবল মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে একটি ছোট্ট ভাষণ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করতে চান, সেটাই ছিল তাঁর মূল বাজেট ভাষণ।
পরিস্থিতি এখন সে রকমই। এখন দেখা যাক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ে কী বলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার এক লেখক বাজেট নিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘বাজেট শুধু সেই সব মানুষের জন্য নয়, যাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। বরং বাজেট প্রত্যেকের জন্য, যাদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তাদের কাছে যে অর্থ আছে, সেটাই যথেষ্ট।’ সুতরাং সব মানুষকে অর্থমন্ত্রী কতটা স্বস্তি দিতে পারবেন, সেটাই এখন তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।