আট মাসে তিনজন প্রশাসক বসানো হয়েছে ডেল্টা লাইফে। ভেঙে দেওয়া পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ৬৩৮ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে ১১ মাস ধরে নিয়মিত পরিচালনা পর্ষদ নেই। বিমা খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠানটি সাড়ে আট মাস ধরে চলেছে পরপর তিনজন প্রশাসকের নেতৃত্বে। চার মাস করে দায়িত্ব পালন করতে প্রশাসকদের নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। প্রথম দুজন তেমন কিছু করতে না পারায় তৃতীয় প্রশাসক বসানো হলো ১৩ অক্টোবর।
আইডিআরএর সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রথম, সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে দ্বিতীয় এবং আইডিআরএরই আরেক সাবেক সদস্য ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. কুদ্দুস খানকে তৃতীয় প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৯৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ডেল্টা লাইফের জীবন তহবিল রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী আড়াই হাজার। এর বাইরে সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে ২০ হাজার কর্মী রয়েছেন।
আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, ডেল্টা লাইফের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমান একই পদে নিয়োগ পেতে আইডিআরএর কাছে আবেদন করেছিলেন ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। একই বছরের ১৬ নভেম্বর তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করে আইডিআরএ। কারণগুলো হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে আগের মেয়াদে রাজস্ব ফাঁকি ও আর্থিক অনিয়ম, বিমা পলিসি গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারের লিখিত আবেদন, তদন্তকালে নিরীক্ষকদের অসহযোগিতা, সিইও হওয়ার জন্য অসত্য তথ্যের উল্লেখ এবং আইডিআরএর নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থতার অভিযোগ ছিল।
আদিবা রহমানের আবেদন নাকচের পর থেকেই ডেল্টা লাইফের সঙ্গে আইডিআরএর জটিলতা শুরু হয়। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকা উৎকোচ চাওয়ার অভিযোগ করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এরপর চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ডেল্টা লাইফের নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী কামরুল আহসান অভিযোগ করেন, আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন এই কোম্পানির পর্ষদ অন্যায়ভাবে ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর ডেল্টা লাইফের ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে ৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদ্ঘাটন করে এবং তা আদায়ে মামলা দেয়।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উৎকোচ চাওয়ার অভিযোগ করেন একজন, দুদকে অভিযোগ করেন আরেকজন। আদালতে রিট করেন আবার ভিন্নজন। এতেই মনে হয় ডেল্টা লাইফ আমার বিরুদ্ধে অপকৌশলের পথ বেছে নিয়েছে।’
প্রশাসক নিয়োগ কি চলতেই থাকবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভবিষ্যতের কথা তো কিছুই বলা যায় না।’
সংবাদ সম্মেলনের তিন দিনের মাথায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিতে প্রশাসক হিসেবে আইডিআরএর সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে নিয়োগ দেয় সংস্থাটি। দায়িত্ব নেওয়ার দিনই প্রশাসক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কোম্পানির ব্যবসায়িক ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না এবং পলিসি হোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করাই হবে তাঁর মূল কাজ।
কিন্তু সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা কর্মীদের পদোন্নতি ও বদলি করার পদক্ষেপ নিতে থাকেন। আগে কেনা শেয়ারও বিক্রি করে দেওয়া হয় তাঁর উদ্যোগে। এ বিষয়ে ডেল্টা লাইফ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে অভিযোগ করে।
সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দায়িত্ব পালনকালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন আইডিআরএতে দাখিল করেছি। আরও সময় পেলে সম্পূর্ণ প্রতিবেদন করা যেত। দুই–তিন বছর ধরে পলিসি হোল্ডারদের বিমা দাবি পরিশোধ করছিল না বলে লাভে শেয়ার বিক্রি করে তাদের দাবি মেটানো ঠিক কাজই হয়েছে।’
সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহ পর ১৮ ফেব্রুয়ারি দুদকে ডেল্টা লাইফের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট পল্লব ভৌমিক দুদকে এক আবেদনে বলেন, এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকা উৎকোচ চাওয়ার অভিযোগটি অসত্য ও বানোয়াট।
কোম্পানির মানবসম্পদ বিভাগের নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী কামরুল হাসানও এক চিঠিতে মোল্লাকে জানান, উৎকোচ দাবি করার একটি টাইপ করা কাগজ পল্লব ভৌমিককে দিলে তিনি তাতে স্বাক্ষর দিতে প্রথমে অস্বীকার করেন।
এ বছরের ৯ জুন রফিকুল ইসলামকে নতুন প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। কিছুই করতে না পেরে ১০ অক্টোবর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। নতুন প্রশাসক মো. কুদ্দুস খানকেও সময় দেওয়া হয়েছে চার মাস।
একের পর এক প্রশাসক নিয়োগ সম্পর্কে ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান গত শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইডিআরএর এখতিয়ারে আছে বলেই তা করছে। তবে ভালো একটা কোম্পানিকে নিয়ে আইডিআরএ কতটা উচিত কাজ করছে, সেটা একটা প্রশ্ন।’ পল্লব ভৌমিককে চার ঘণ্টা আটকে রেখে দুদকে করা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।
সম্প্রতি ডেল্টা লাইফের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ৬৩৮ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে বলে একটি প্রতিবেদন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে জমা দিয়েছে আইডিআরএ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আদিবা রহমান বলেন, ‘একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বানিয়ে বানিয়ে এসব হিসাব করা হয়েছে।’