রোজার পণ্য

পাইকারিতে দাম কিছুটা কমলেও অস্বস্তি

ভোজ্যতেল ছাড়া পাইকারি বাজারে ছোলা, মটর, মসুর ও চিনির দাম কমেছে। খুচরা বাজারে সেভাবে প্রভাব না পড়ায় সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা।

পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এক সপ্তাহে ছোলার দাম কমেছে কেজিতে চার টাকা। বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি ভালো মানের ছোলার সর্বোচ্চ দাম ছিল ৬৩ টাকা। কিন্তু পাইকারি বাজারে পড়তি দামের আঁচ খুচরা বাজারে এখনো পুরোপুরি পড়েনি। গতকাল শুক্রবার খুচরা বাজারে ভালো মানের ছোলা ৭৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে দামের ব্যবধান ১৫ টাকা।

বাজারের রীতি অনুসারে, পাইকারি বাজারে দাম কমার প্রভাব খুচরা বাজারে পড়তে কয়েক দিন সময় লাগে। খুচরা বাজারে যত দিনে দাম কমবে, তত দিনে রোজার কেনাকাটা শেষ হয়ে যাবে অনেকের। আবার দাম কমার পরও গত বছরের চেয়ে এবার রোজায় বাড়তি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

খাতুনগঞ্জ ডাল মিল মালিক সমিতির সভাপতি সঞ্জয় দেব প্রথম আলোকে বলেন, খাতুনগঞ্জে এক সপ্তাহ ধরে ছোলার দাম পড়তির দিকে। পাইকারিতে এখন প্রতি কেজি উন্নত মানের ছোলার দাম ৬৩ টাকার বেশি নয়। সাধারণ মানের দুই ধরনের ছোলার দাম ৫৬ ও ৫৯ টাকা।

বিশ্ববাজারে অস্থিরতা আছে। ভবিষ্যতে নিত্যপণ্যের আমদানি যেন স্বাভাবিক থাকে, সে দিকে নজর রাখা দরকার।
মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি

খুচরা বাজারে এখন সাইনবোর্ডে রোজার পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের দর থাকে। কিন্তু নগরের বহদ্দারহাট ও কর্ণফুলী কমপ্লেক্স ঘুরে খুচরা বাজারে বৃহস্পতিবারের পাইকারি ক্রয়মূল্য পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে সাধারণ মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। মাঝারি মানের ছোলার দাম ৭৫ টাকা। সবচেয়ে ভালো মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭৮ টাকা।

নগরের ২ নম্বর গেটে কর্ণফুলী ট্রেডার্সের মালিক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভালো মানের ছোলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে কম। দু-তিন রকমের ছোলার মিশ্রণ ‘ভালো’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছোলার সঙ্গে ঝুট বেশি আসছে। অপচয় ও পরিবহন খরচ যোগ করে বিক্রি করতে হচ্ছে তাঁদের। তবে এক মাসের ব্যবধানে ছোলার দাম কিছুটা কমেছে।

দাম কমছে পাইকারিতে, খুচরায় ধীরে

এবারের রোজায় বিপুল পরিমাণ ছোলা এনেছেন আমদানিকারকেরা। জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছোলা আমদানি হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার টন। গত বছরের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও ছোলার সরবরাহ বৃদ্ধিতে বাজার অস্থিতিশীল হয়নি। ছোলার মতো মটর ডাল ও মসুর ডালের আমদানিও পর্যাপ্ত বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

গম ও ডালজাতীয় পণ্যের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিকারক পর্যায়ে গত ১৫ দিনে ডালজাতীয় পণ্য ও গম কেজিতে দুই থেকে চার টাকা কমেছে। গতবারের তুলনায় চাহিদা কম ও বেচাকেনা কমে আসায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে সরবরাহে ঘাটতি নেই।

পাইকারি বাজারে এক সপ্তাহ ধরে ছোলার মতো মটর ডাল, মসুর ডাল ও চিনির দামও কমেছে। ভাঙা মটর ডাল ২ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ৪৭ টাকা। মোটা মসুর ডালও পাইকারি বাজারে ২ টাকা কমে ৮৮ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। চিনির দাম উঠেছিল কেজি ৭৪ টাকা। সেখান থেকে ২ টাকা কমে ৭২ টাকায় নেমেছে।

ছোলার মতো না হলেও এ সব কটি পণ্যের খুচরা মূল্যের সঙ্গে পাইকারি মূল্যের ব্যবধান বেশি। পাইকারি বাজারে ৭২ টাকার চিনি খুচরায় ৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মটর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। মটর ডালে দামের ব্যবধান কেজিতে আট টাকা। মোটা মসুর ডাল পাইকারির চেয়ে ৭ টাকা বেশি দরে অর্থাৎ ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ভোজ্যতেলে উল্টো চিত্র

পাইকারি বাজারে দাম কমেনি ভোজ্যতেলের। সপ্তাহ দু-এক আগে ভোজ্যতেলের দাম সরকার নির্ধারিত দরের নিচে চলে আসে। এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে পাইকারি বাজারে। কারখানা থেকে নতুন সরবরাহ আদেশ না আসায় বাজার অস্থির বলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার পাইকারি বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৪৪ টাকা ৬০ পয়সায়। এই দর সরকার নির্ধারিত খুচরা দরের চেয়েও সাড়ে আট টাকা বেশি। দুই দফা ভ্যাট কমানোর পর গত ২০ মার্চ সরকার সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে। এতে প্রতি লিটার বোতলজাত তেলের দাম ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর খোলা তেল দাম নির্ধারণ করা হয় ১৩৬ টাকা লিটার। সরকার নির্ধারিত দরে এক সপ্তাহ আগেও সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও এখন আর মিলছে না।

আমদানিকারক পর্যায়ে গত ১৫ দিনে ডালজাতীয় পণ্য ও গম কেজিপ্রতি দুই থেকে চার টাকা কমেছে। সরবরাহে ঘাটতি নেই।
আবুল বশর চৌধুরী, চেয়ারম্যান, বিএসএম গ্রুপ

পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, পরিশোধন কারখানা থেকে ভোজ্যতেল সরবরাহের জন্য ‘এসও বা সরবরাহ আদেশ’ বিক্রি করা হয়। এই সরবরাহ আদেশ বেচাকেনা বা হাতবদল হওয়ার পর কারখানা থেকে পণ্য সংগ্রহ করেন ব্যবসায়ীরা। এক সপ্তাহ ধরে কারখানাগুলো পুরোনো সরবরাহ আদেশ অনুযায়ী ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে। নতুন করে সরবরাহ আদেশ বাজারে ছাড়ছে না। এতে সামনে সংকট তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কায় বাজারে দাম বাড়ছে।

অবশ্য পাইকারিতে খোলা তেলের দাম বাড়লেও খুচরায় প্রভাব পড়ছে না। কারণ, খুচরা দোকানে বোতলজাত আকারে তেল বিক্রি হয়। বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত দর ১৬০ টাকা।

কমার পরও গতবারের চেয়ে বাড়তি

দাম কমার পরও এবারের রোজায় গতবারের চেয়ে অনেক পণ্যই বেশি দরে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। এর প্রধান কারণ, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম গতবারের তুলনায় বাড়তি।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৩০-১৪০ টাকা। দাম কমানোর পরও এখন তা কিনতে হচ্ছে ১৫৮-১৬৫ টাকায়। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় দাম এখনো প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।

ডালজাতীয় পণ্যের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। দাম কমার পরও গতবারের তুলনায় এবার বেশি দরেই কিনতে হচ্ছে ডাল। যেমন মোটা দানা মসুর ডালের কেজি গত বছর এ সময়ে ছিল ৬৫-৭০ টাকা, এখন ৯৫-১০০ টাকা। বৃদ্ধির হার ৪৪ শতাংশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাইকারি বাজারে দাম কমার সুফল নিশ্চিত করতে নিয়মিত বাজার তদারকি করা উচিত। তদারকি থাকলে কেউ বাড়তি সুবিধা নিতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা আছে। ভবিষ্যতে নিত্যপণ্যের আমদানি যেন স্বাভাবিক থাকে, সে দিকে নজর রাখা দরকার। প্রয়োজনে সরবরাহ বাড়াতে সরকারকে নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে।