নগদের মালিকানায় বারবার বদল

এবার নগদের ৫১% মালিকানা যাচ্ছে ডাক অধিদপ্তরের কাছে, বাকি ৪৯% থাকবে বর্তমান মালিকদের হাতে। সরকারি কোম্পানি হচ্ছে নগদ।

মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’

দেশে মোবাইল ফোনে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে ‘নগদ’ এখন বেশ পরিচিত একটি নাম। মাত্র আড়াই বছরে তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নগদ যেভাবে বাজারের বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, সেভাবে আগে কেউ পারেনি।

তবে এখনো নগদের মালিকানা ও ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে যে জটিলতা, সেটির সুরাহা হয়নি। নগদকে সরকারের ডাক অধিদপ্তর সেবা হিসেবে প্রচার করা হলেও এর মালিকানায় ডাক অধিদপ্তরের কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার আর্থিক সেবা দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো চূড়ান্ত অনুমোদন নেই নগদের।

এই অবস্থায় নগদের সেবাকে আইনি কাঠামোর আওতায় এনে এটাকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাতে নগদের ৫১ শতাংশ মালিকানা থাকবে ডাক অধিদপ্তরের কাছে। বাকি ৪৯ শতাংশ পাবেন এখনকার মালিকেরা। নগদকে আইনি কাঠামোয় আনার জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত এমন পরিকল্পনাই করেছে বলে জানা গেছে।

নগদ এখন ডাক অধিদপ্তরের ব্র্যান্ড ব্যবহার করছে। এতে ডাক অধিদপ্তরের কোনো মালিকানা নেই।
সিরাজ উদ্দিন, মহাপরিচালক, ডাক অধিদপ্তর

এ নিয়ে জানতে চাইলে ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) সিরাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নগদ এখন ডাক অধিদপ্তরের ব্র্যান্ড ব্যবহার করছে। এতে ডাক অধিদপ্তরের কোনো মালিকানা নেই। তাই ৫১ শতাংশ মালিকানা নিতে ডাক অধিদপ্তরের অধীনে একটি কোম্পানি গঠন করা হচ্ছে। এরপর ৯ সদস্যের নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হবে। পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ পাঁচজন পরিচালক হবেন সরকারের প্রতিনিধি।

সিরাজ উদ্দিন আরও বলেন, ‘মালিকানা নিতে আমরা কোনো টাকা দেব না। নগদ শুরু থেকে আমাদের ব্র্যান্ড ব্যবহার করছে। এর মূল্যমান হিসেবে নগদের ৫১ শতাংশ মালিকানা পাবে ডাক অধিদপ্তর। এ জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে অন্যান্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মতো চলবে নগদ।’

২০১৬ সালে মোবাইলে আর্থিক সেবা দিতে গড়ে ওঠে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এতে নগদের প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী ও বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদের পাশাপাশি মালিকানায় যুক্ত হন গ্রামীণফোন ও গুগলের সাবেক কর্মকর্তা কাজী মনিরুল কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, সৈয়দ আরশাদ রেজা ও মিজানুর রহমান। ২০১৭ সালে ডাক অধিদপ্তরের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার কাজ নেয় থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ কার্যক্রম শুরু করে নগদ।

নগদের কার্যক্রম শুরুর আগেই অংশীদারদের কেউ কেউ থার্ড ওয়েভের শেয়ার ছেড়ে দেন। এর মধ্যে কাজী মনিরুল কবির ছেড়ে দিলে মালিকানায় যুক্ত হন দুই সাংসদ নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এ ছাড়া নতুন করে মালিকানায় যুক্ত হন রেজওয়ানা নূর।

যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির নাম পরিবর্তন করে নগদ করা হয়েছে। আর মালিকানায় যুক্ত হয়েছেন নতুন অনেকে, ছেড়েও দিয়েছেন কেউ কেউ। আড়াই বছরে দফায় দফায় একাধিকবার মালিকানায় পরিবর্তন হয়েছে নগদের। এখন নগদের পরিচালক ৯ জন, যাঁরা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের ১ জন করে নাগরিক রয়েছেন। অন্য ৬ জন বাংলাদেশি।

নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদ নিজের নামে থাকা সব শেয়ার টেলিকম এশিয়া হোল্ডিং ও অন্য পরিচালক শাফায়েত আলমের কাছে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হস্তান্তর করেছেন। ১ জুলাই থেকে তিনি টেলিকম এশিয়া হোল্ডিংয়ের মনোনীত পরিচালক হিসেবে এমডি পদে আছেন। প্রাইম ব্যাংকের সাবেক এমডি রাহেল আহমেদ ১ জুলাই থেকে ফিনক্লুশন ভেঞ্চারের প্রতিনিধি হিসেবে নগদের পরিচালক। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও (সিইও)।

রেজাউল হোসেন ১ জুলাই থেকে নগদের পরিচালক হয়েছেন ফিনটেক হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে। ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচালক হয়েছেন সাফায়েত আলম। তিনি নগদের নির্বাহী পরিচালকও। মারুফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আমিনুল হক নগদের পরিচালক হিসেবে আছেন টেলিকম এশিয়া হোল্ডিংয়ের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে। সিঙ্গাপুরের কোম্পানি নিবন্ধনের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ফিনক্লুশন ভেঞ্চার ও টেলিকম এশিয়া একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান।

এর বাইরে নগদে ফিনক্লুশন ভেঞ্চারের পক্ষে সিঙ্গাপুরের নাগরিক ফয়সাল আহসান চৌধুরী ও স্টালওয়ার্টে লিমিটেডের পক্ষে কানাডার নাগরিক তামজিদ রহমান পরিচালক। আর মিয়ার্স হোল্ডিংয়ের পক্ষে পরিচালক হন ব্রিটিশ নাগরিক গিলস এলাস্টার জেমস ফার্লে, যাঁর কার্যালয় ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে।

নগদের এমডি তানভীর আহমেদ গত রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা এখন নগদের মালিকানায় আছেন, তাঁদের মধ্যে আমিসহ বেশির ভাগই দেশীয় কোম্পানির। এর মধ্যে নগদে কর্মীদেরও শেয়ার আছে। একটি কোম্পানি আগে সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত ছিল। এখন সেখানে কোনো কার্যক্রম নেই। পাশাপাশি নগদে তিনটি বিদেশি কোম্পানির তিনজন প্রতিনিধিও আছেন। নতুন করে লকডাউন না হলে চলতি বছরেই নগদ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপ নেবে।’

কার্যক্রম শুরুর এক বছর পর গত বছরের এপ্রিলে নগদকে কার্যক্রম চালিয়ে নিতে সাময়িক অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমএফএস-সংক্রান্ত নীতিমালা ও বেঁধে দেওয়া লেনদেনের সীমা যথাযথভাবে মেনে চলতে বলা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ে সব শর্ত পূরণ ও আলাদা কোম্পানি গঠনের কাজ শেষ না সেপ্টেম্বর (চলতি মাস) পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি নগদে জমা হওয়া গ্রাহকের টাকার লেনদেনে যাতে ডাক অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়, সে জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মোবাইলে আর্থিক সেবায় (এমএফএস) বিকাশের পরই এখন নগদের অবস্থান। সেবাটির মাধ্যমে দৈনিক ৭০০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। সহজে হিসাব খোলার সুবিধা ও ব্যবসার কৌশলের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সেবাটি। প্রায় সাড়ে ৫ কোটি গ্রাহক নিবন্ধন নিয়েছেন নগদের।