শহর কিংবা গ্রাম—সর্বত্র এখন হাত বাড়ালেই বিদেশি ফল মিলছে। নানা রকমের বিদেশি ফল এতই সহজলভ্য যে এর জন্য নির্দিষ্ট মার্কেট বা স্থান পর্যন্ত যেতে হয় না, এখানে-ওখানে ফুটপাতে কিংবা ভ্যানওয়ালাদের কাছে পাওয়া যায়। মোটামুটি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকায় দেশীয় ফলের পাশাপাশি মানুষ বিদেশি ফলও কিনছে।
আমদানির হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ১৬ লাখ ৮৮ হাজার কেজি বিদেশি ফল খাচ্ছে দেশের মানুষ। খুচরা মূল্যে প্রতিদিন ফল বেচাকেনা হচ্ছে কমবেশি ২৭ কোটি টাকার। বছরের পাঁচ মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চলে বিদেশি ফল। কারণ, এ সময়ে দেশীয় ফলের সরবরাহ কম থাকে। দেশে আম, লিচু, তরমুজের মৌসুমে অবশ্য বিদেশি ফলকে হটিয়ে একচেটিয়া রাজত্ব চলে দেশীয় ফলের।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ায় ফলের চাহিদা বাড়ছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ফল আমদানি করে পুষ্টি চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখছেন। নতুন নতুন বিদেশি ফল আনছেন। এদিকে গবেষকেরাও নজর দিয়েছেন। আবার দেশীয় উদ্যোক্তারাও বিদেশি ফলের চাষ করছেন। এর ফলে বাজারই বলে দেবে কোন ফল আমদানি হবে, কোনটি হবে না।
বিদেশি ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় আপেল। এর পরের অবস্থান মাল্টার। এ দুটি ফলের বাইরে কমলা, ডালিম, আঙুর, নাশপাতি ও লেবুজাতীয় ফল আমদানি হয়। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ১৬ হাজার টন। মোট আমদানির ৭৭ শতাংশই হচ্ছে আপেল ও মাল্টা।
২০২০ সালের ডিসেম্বর ও চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের দুটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আপেল আমদানিতে তৃতীয় ও মাল্টায় ষষ্ঠ। তবে মাল্টা খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে ১৪তম অবস্থান বাংলাদেশের।
ফল আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিমুল হক এশা প্রথম আলোকে, দেশে যেসব ফল উৎপাদিত হয় না, সেগুলোই আমদানি হচ্ছে। আমদানিকারকেরা এ দেশে ফলের বাজার তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, একসময় থাইল্যান্ড থেকে পেয়ারা আসত। বাজার তৈরি হওয়ায় এখন দেশেই সেটি উৎপাদিত হচ্ছে। তাই পেয়ারা আমদানির দরকার হচ্ছে না। এভাবেই একদিন দেশীয় উৎপাদন দিয়ে অন্য যেসব বিদেশি ফলের চাহিদা মেটানো যাবে, সেগুলো আমদানি হবে না।
বর্তমানে ফুটপাতে বা ভ্যানে বিক্রি হওয়া বিদেশি ফলকে ৯ বছর আগে বিলাসপণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আপেল, কমলা ও নাশপাতিকে বিলাসপণ্যের তালিকায় রাখা হয়েছিল। ‘বিলাসপণ্যের ব্যবহার কমানো’র যুক্তিতে ফল আমদানির ক্ষেত্রেও আরোপ করা হয় নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক। তাই ফল আমদানিতে এখনো ৮৯ শতাংশের বেশি করভার রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমদানি বাড়ছে। অর্থাৎ উচ্চ শুল্ক দিয়ে আমদানি করা ফল খেয়েও সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছেন ক্রেতাসাধারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাজা ফল আমদানি হয়েছে ৩০ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, ভুটান ও ব্রাজিল থেকেই এসেছে মোট আমদানির ৯৪ শতাংশ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে সীমিত পরিমাণে ফল আসছে। দেশে খুচরা পর্যায়ে বছরে ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাজস্ব বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী করোনার কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ফল আমদানি সামান্য কমেছে। গত পাঁচ অর্থবছরের হিসাবে গড়ে ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে বিদেশি ফল আমদানি। তবে দেশীয় ফলের উৎপাদন বাড়ছে ১০-১২ শতাংশ হারে।
‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক মেহেদী মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বর্তমানে ১০-১২টি বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ও ডালিম—এই চার ফলের উৎপাদন যেভাবে বাড়ছে, তাতে পর্যায়ক্রমে এগুলোও একসময় আমদানি করতে হবে না। তিনি আরও বলেন, এখন সীমিত পরিমাণে ড্রাগন, পেয়ারা, কাঁঠাল, লটকন, আম ও জলপাই রপ্তানি হচ্ছে।