দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার পরও বিদেশে পাচার করা অর্থ অল্প কর দিয়ে দেশে এনে বৈধ করার সুযোগ বহাল রাখলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে ৯ জুন বাজেট ঘোষণার দিন পাচারের অর্থ বৈধ করার ঢালাও যে সুযোগের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেখানে কিছুটা সংশোধন আনা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী গতকাল বুধবার সংসদে জানিয়েছেন, পাচার করা অর্থ বৈধ করতে হলে আগে তা দেশে আনতে হবে। দেশে না আনলে অর্থাৎ বিদেশে থাকা অর্থ বৈধ করা যাবে না। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশ থেকে এনে ৭ শতাংশ কর দিয়ে ওই অর্থ কর নথিতে দেখালেই কেবল বৈধ হয়ে যাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে প্রশ্ন করবে না।
বিদেশে বাড়ি-গাড়ির মতো স্থাবর সম্পদ এবং অর্থ দেশে না এনেও কর দিয়ে বৈধ করার যে সুযোগের প্রস্তাবটি বাজেট ঘোষণার দিন অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন, তা অবশেষে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে সম্পদ বা অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি হিসেবে সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কর কর্মকর্তাদের।
জাতীয় সংসদে গতকাল ২০২২ সালের অর্থবিল পাসের সময় এ–সংক্রান্ত দুটি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যে দুটি প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা হলো বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি (অর্থ, গয়না ইত্যাদি) বাংলাদেশে না আনলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর এবং বিদেশে থাকা স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ এফ ধারায় এ দুটি সংশোধনী আনা হয়। আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট ঘোষণার সময় পাচার করা অর্থ বা সম্পদ বৈধ করার তিন ধরনের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার মধ্যে দুটি প্রত্যাহার করেছেন, আর একটি বহাল রেখেছেন।
পাচারে অর্থ বৈধ করা–সংক্রান্ত সংশোধনীসহ বিদ্যমান কর ও শুল্কহারের সামান্য পরিবর্তনের বিধান রেখে গতকাল জাতীয় সংসদে অর্থবিল-২০২২ সংশোধিত আকারে পাস করা হয়েছে। তার আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন। বিলটি তিনি উত্থাপন করেছিলেন ৯ জুন।
জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল অনুষ্ঠিত অধিবেশনে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংসদ সদস্যরা সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তার মধ্যে নতুন অর্থবছরের জন্য আর্থিক বিধান-সংবলিত কর ও শুল্ক প্রস্তাবের জন্য কিছু আইন ও বিধান সংশোধন করা হয়। বিলে উল্লিখিত বিধানগুলো কার্যকর করার বিধান করা হয় ২০২২ সালের ১ জুলাই অর্থাৎ আগামীকাল থেকে। উত্থাপিত বিলের বিভিন্ন কর প্রস্তাবের ওপর মোট ১৭টি সংশোধনী গ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী।
সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্য দেন। সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপির হারুনুর রশীদ ও রুমিন ফারহানা এবং গণফোরামের মোকাব্বির খান প্রমুখ।
অর্থবিলের আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকার, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, ফখরুল ইমাম, মসিউর রহমান, রওশন আরা মান্নান, স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বিলের ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণ এবং সংশোধনীর প্রস্তাব আনেন। কিন্তু ১৭টি বাদে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
এদিকে গতকাল সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, ‘অর্থবিলের ১৭টি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করছি। অর্থনীতির এলাকায় স্বাভাবিক সময় বিরাজ করলে আমরা সংসদ সদস্যদের প্রস্তাবগুলোর অনেক কিছু বিবেচনা করতে পারতাম। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের বাকি সংশোধনী প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার ওপর স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করায় সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের ১৩ বছরের অর্জন রূপকথার গল্পগাথাকেও হার মানায়।
অর্থমন্ত্রী জানান, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সময়ে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল প্রথম, যেখানে ১৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে চীন দ্বিতীয় হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছর এবং আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশ পরিচালনায় হিরণ্ময়ী নেতৃত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান অর্থমন্ত্রী
এবারের বাজেটে আড়াই শতাংশ করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কর সুবিধা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বছরে ১২ লাখ টাকার বেশি নগদে খরচ করতে পারবে না—এমন শর্ত দেওয়া হয়। এ শর্ত শিথিল করা হয়েছে। এ সীমা বাড়িয়ে বছরে ৩৬ লাখ টাকা করা হয়েছে। ৩৬ লাখ টাকার বেশি বাকি অর্থ লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে করতে হবে।
এ ছাড়া একক লেনদেন পাঁচ লাখ টাকার বেশি হলেও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। এ দুই শর্ত পূরণ করলেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য সাড়ে ২২ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য করপোরেট করহার ৩০ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ২৭ শতাংশ আরোপ হবে।
নতুন কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রথম দুই বছর কর শনাক্তকরণ নম্বরের (টিআইএন) বিপরীতে শুধু রিটার্ন জমা দিলেই চলবে। আনুষঙ্গিক কোনো প্রামাণিক দলিলপত্র জমা দিতে হবে না। অর্থবিল পাসের সময় এ সংশোধনীও আনা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে অনুদানকে খরচ দেখানোর আগের নিয়ম বহাল রাখা হয়েছে।