বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় খাল-বিল ও পুকুরে উৎপাদিত দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছ এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এসব মাছের মধ্যে রয়েছে পাবদা, গুলশা, শিং, ট্যাংরা ইত্যাদি। রপ্তানি হয় ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপান, কানাডা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ভারত, নেপাল প্রভৃতি দেশে।
স্থানীয় মৎস্য বিভাগ বলছে, ভরা মৌসুমে বগুড়া অঞ্চলের পুকুর ও খালে-বিলে প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার মেট্রিক টন দেশি মাছ উৎপাদিত হয়। পোনা ছাড়ার পর চার মাসের মধ্যে তা রপ্তানির উপযোগী হয়ে ওঠে। মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন বা ৩০ শতাংশের কিছু বেশি রপ্তানি হয়। সব মিলিয়ে বগুড়া অঞ্চল থেকে বছরে মাছ রপ্তানি হয় ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকার।
প্রায় এক দশক ধরে বগুড়ার কাহালু, দুপচাঁচিয়া, আদমদীঘি ও শিবগঞ্জ এবং জয়পুরহাটের কালাই, ক্ষেতলাল, আক্কেলপুর ও পাঁচবিবি উপজেলায় সহস্রাধিক মৎস্য খামারি এবং চাষি পুকুর ও খালে-বিলে বাণিজ্যিকভাবে দেশি মাছের চাষ করছেন। পাশাপাশি মাছের পোনা উৎপাদনে দুই জেলায় গড়ে উঠেছে শতাধিক হ্যাচারি। চাষটা শুরু হয়েছিল মাগুর মাছ দিয়ে। লাভজনক হওয়ায় পরবর্তী সময়ে চাষের তালিকায় যোগ হয় শিং, ট্যাংরা, কই, পাবদা, গুলশাসহ নানা প্রজাতির মাছ। এসব মাছের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রপ্তানিকারকেরা খাল-বিল-পুকুর ও আড়ত থেকে কিনে নেন। বাকি মাছ স্থানীয় বাজারগুলোর পাশাপাশি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়।
শিক্ষিত অনেক তরুণ দেশি মাছ চাষে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করছেন। তেমনই একজন হাতিয়র গ্রামের খামারি কাজী জাকির হোসেন। তিনি জানান, ১২০ বিঘা আয়তনের পুকুরে মাছ চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত খরচ করেছেন ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৪ হাজার মণ দেশি মাছ উৎপাদনের আশা করছেন তিনি।জাকির হোসেন আরও জানান, আট বছর আগে সামান্য পুঁজি নিয়ে ৮০ শতকের পুকুরে দেশি মাগুর চাষ শুরু করেন। পরে অন্যান্য মাছ চাষেও ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন।
জানতে চাইলে খুলনার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কেবিসি ইন্টারন্যাশনালের মালিক গোপাল বিশ্বাস বলেন, ‘তিন বছর ধরে বগুড়া ও জয়পুরহাট থেকে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ পাবদা মাছ কিনে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে রপ্তানি করছি।’
সম্প্রতি কাহালু উপজেলার স্টেশনবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, কার্টনে বরফ মুড়িয়ে পাবদা মাছ প্যাকেট করা হচ্ছে রপ্তানির জন্য। প্রতিটি কার্টনে ২১ কেজি করে পাবদা মাছ প্যাকেট করা হয়।
মৎস্য খামারি ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানির জন্য ২০ থেকে ২৫টিতে এক কেজি হয় এমন আকারের পাবদার চাহিদা বেশি। এখন প্রতি মণ পাবদা ১০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। করোনার আগে বিক্রি করতেন ১৬ হাজার টাকায়।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি শফিকুল ইসলাম কাহালু উপজেলার বিবিরপুকুরে হ্যাচারি গড়ে রেণু থেকে পাবদা, ট্যাংরা, শিং, কই, মাগুর ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদন করেন। তিনি বলেন, ‘চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন হরেক প্রজাতির দেশি মাছের পোনা উৎপাদন করছি। করোনার মধ্যেও ৩ হাজার কেজি পাবদার পোনা উৎপাদন করেছি আমরা।’
মাছের পাইকার বিকাশ রায় প্রথম আলোকে জানান, তিনি চট্টগ্রামের রপ্তানিকারকদের কাছে এ গ্রেডের অর্থাৎ বড় আকারের পাবদা ৩৩০-৩৪০ টাকা ও গুলশা ৫২৫-৫৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকার আড়তদারসহ দারাজ বিডি ডটকম, চাল ডাল ডটকম, স্বপ্ন, আন্দাজ, বিডি ফুডস, মাসুদ ফুডস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানেও মাছ সরবরাহ করেন।
চট্টগ্রামের রপ্তানিকারক মিলন ভট্টাচার্য জানান, তিনি বগুড়া ও জয়পুরহাট থেকে পাবদা, গুলশা ও শিং মাছ সংগ্রহ করে ইউরোপ, আমেরিকা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) পাঠান।
জানতে চাইলে বগুড়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার আনোয়ারুল কবীর আহম্মেদ বলেন, এই জেলায় বছরে মাছের চাহিদা ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। ৩৩ হাজার মৎস্যচাষি ও খামারি বছরে উৎপাদন করেন ৮৪ হাজার মেট্রিক টন। তিনি আরও জানান, খামারি ও মৎস্যচাষিদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশই দেশি জাতের মাছ চাষ করেন।