‘অপচয়ের’ উদাহরণ দুই ভবন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স এবং ডাক ভবন দুটি তৈরিতে যত আগ্রহ ছিল, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের এখন সেখানে যেতে ততটাই অনাগ্রহ।

২০১৯ সালে নির্মাণ শেষ হওয়ার পর দুই বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে দৃষ্টিনন্দন ডাক ভবনটি। সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে
প্রথম আলো

প্রকল্পের নামে কীভাবে অর্থের অপচয় হচ্ছে, তার উদাহরণ হয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুদৃশ্য দুটি ভবন। ৩১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ভবন দুটি অব্যবহৃত পড়ে আছে প্রায় দুই বছর ধরে। দুই ভবনের একটি ডাক বিভাগের ডাক ভবন, অপরটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স।

দৃষ্টিনন্দন দুটি ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের যত আগ্রহ ছিল, এখন সেখানে যেতে ততটাই অনাগ্রহ। ফলে দুই বছর ধরে অযত্ন–অবহেলায় পড়ে থাকা ভবন দুটি রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ধুলাবালির আস্তরণ পড়েছে ভবন ও চারপাশের দেয়ালে। কবে নাগাদ দৃষ্টিনন্দন আধুনিক এ দুই ভবন ব্যবহার শুরু হবে, তা–ও কেউ নিশ্চিত করতে পারছেন না। যদিও মন্ত্রণালয় ও ডাক বিভাগ বলছে, ভবন দুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে তারা।    

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এ দুই ভবনের মধ্যে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স নামের ভবনটি নির্বাচন কমিশন ভবনের পেছনে। ১৩ তলা বিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ভবনটির নির্মাণকাজ ২০১৪ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ২০১৯ সালে। এটি তৈরিতে খরচ হয় ২২২ কোটি টাকা। দেশের বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম করার পাশাপাশি সচিবালয় থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে ভবনটি করা হয়েছিল। কিন্তু ভবন তৈরির পর এখন সেখানে যেতে আগ্রহী নন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্সের সামনেই ডাক ভবন। লাল রঙের ১৪ তলা সুদৃশ্য ভবনটি যে কারও নজর কাড়বে প্রথম দেখায়। ভবনটি করা হয়েছে ডাকবাক্সের আদলে। পৌনে এক একর জায়গার ওপর ৯২ কোটি টাকা খরচে তৈরি এ ভবনটির কাজও শেষ হয় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। ডাক বিভাগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এখন সেখানে যেতে রাজি হচ্ছেন না ডাক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সরকারের দুটি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেন নতুন ভবনে যেতে রাজি হচ্ছে না? এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনে করছেন, আগারগাঁওয়ে নতুন ভবনে গেলে সচিবালয় থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। এতে সচিবালয়কেন্দ্রিক যে সুবিধা তাঁরা ভোগ করেন, তাতে ছেদ পড়বে। আবার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভাবশালী একটি অংশের চিন্তা সচিবালয় থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব নিয়ে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে সচিবালয়ে অফিস করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী আগারগাঁওমুখী হওয়ার ঝক্কি পোহাতে চান না।

# বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা সচিবালয় ছাড়তে চান না প্রভাব ও সুযোগ–সুবিধা কমার শঙ্কায়# ডাক বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা গুলিস্তানের জায়গা হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কায় নড়তে চান না

নতুন ভবনে না যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভবনটি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করাতে চাই। কিন্তু করোনার কারণে প্রধানমন্ত্রীর সময় মিলছে না। তাই সেখানে যাওয়া হচ্ছে না।’ করোনার সময়ে পান্থপথে পানি ভবন, আগারগাঁওয়ে পর্যটন করপোরেশনের ভবনে কার্যালয় স্থানান্তরের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সচিব বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত ভবনটি উদ্বোধন করতে।’

এত গেল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স ভবনটি অব্যবহৃত পড়ে থাকার সচিবের দাপ্তরিক ব্যাখ্যা। এ ভবনের পাশের ‘ডাক ভবন’ অব্যবহৃত পড়ে থাকার কারণ খুঁজতে গিয়েও জানা গেল, ডাক বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের অনীহার বিষয়টি। বর্তমানে ডাক বিভাগের সদর দপ্তর অবস্থিত রাজধানীর গুলিস্তানে, যেটি জিপিও (জেনারেল পোস্ট অফিস) মোড় হিসেবে অধিক পরিচিত। রাজধানীর জিরো পয়েন্টের কাছে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে ডাক বিভাগের সদর দপ্তর ও স্থানীয় ডাকঘর অবস্থিত। ডাক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আশঙ্কা, আগারগাঁও নতুন ভবনে স্থানান্তর হলে গুলিস্তানের এ মূল্যবান জায়গা তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই তাঁরা এ জায়গা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় নতুন ভবনে যেতে রাজি হচ্ছেন না। এ জন্য নতুন ভবনে না যেতে আন্দোলনও করেছেন ডাক বিভাগের কর্মচারীরা।

গত ২০১৮ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছিলেন, ডাক বিভাগের সদর দপ্তর আগারগাঁও চলে গেলে গুলিস্তানে খালি জায়গাটিকে সবুজময় করা হবে। যাতে পল্টন, মতিঝিলসহ ওই এলাকার মানুষ সেখানে হাঁটতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশের পর থেকেই গুলিস্তানে জায়গা হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন ডাক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁরা চান, নতুন ভবনে গেলেও গুলিস্তানের জায়গাটিও যেন ডাক বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

জানতে চাইলে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সিরাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলিস্তানের ৪ দশমিক ৭৯ একর জায়গার মধ্যে আমরা তিন একর জায়গা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু জিপিও রাখা জরুরি। বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানো হয়েছে।’

এদিকে দিনের পর দিন ডাক ভবনের সদর দপ্তর এভাবে খালি পড়ে থাকাকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর ডাক বিভাগের গুলিস্তানের বর্তমান জায়গা সবুজময় করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলছে, একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নে পুরো জায়গা খালি করতে হবে।

নতুন ডাক ভবন তৈরির পর অব্যবহৃত পড়ে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবনটি উদ্বোধনের জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছি। যেদিন প্রধানমন্ত্রী ভবনটি উদ্বোধন করবেন, সেদিনই ডাক ভবন চালু হবে।’

আগারগাঁওয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্স ভবন। সম্প্রতি তোলা

গত মাসে ভিন্ন ভিন্ন দিনে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এ দুই ভবনে সরেজমিনে গিয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়া গেল না। তবে বাইরে থেকেই দেখা যায়, ভবন দুটির গায়ে জমেছে ধুলাবালির আস্তরণ। এর মধ্যে ডাক ভবনের চারপাশের বেশ কয়েকটি লাইটও নষ্ট হয়ে গেছে। ভবন দুটির নিরাপত্তায় রয়েছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সাংবাদিক পরিচয়ে দুই ভবনে ঢুকতে চাইলে নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, ওপরের নির্দেশ ছাড়া ভেতরে প্রবেশ নিষেধ।

করোনার কারণে ভবন উদ্বোধন না হওয়ার কথা সংস্থা দুটি বললেও গত ১ অক্টোবর রাজধানীর পান্থপথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি ভবন উদ্বোধন হয়। মতিঝিল থেকে সংস্থাটির কার্যালয় স্থানান্তর হয় এ ভবনে। আর আগারগাঁওয়ের ডাক ভবনের আশপাশে পর্যটন করপোরেশনের ভবনটিও উদ্বোধন হয় ১ অক্টোবর করোনাকালে। মহাখালী থেকে করপোরেশনের কার্যালয় সেখানে স্থানান্তরিত হয়।

নতুন ভবন তৈরি করে তা অব্যবহৃত ফেলে রাখার বিষয়ে নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বহুতল ভবন নির্মাণ করে এভাবে খালি ফেলে রাখাটা জাতীয় সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবে দিনের পর দিন জাতীয় সম্পদ খালি রেখে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। যত দ্রুত সম্ভব সমস্যার সমাধান করে ভবন দুটির ব্যবহার শুরুর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।