‘কঠোর বিধিনিষেধে তো দোকান খোলা মানা। তাই বই সাজিয়ে বসি না। তবে প্রতিদিনই দোকানের সামনে আসি। যখন কোনো গাড়ি আসে, তখন কাছে গিয়ে জানতে চাই, বই কিনবে কি না। সারা দিনে হয়তো দু-চারজন ক্রেতা আসেন। তাতে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু পুলিশের চোখে পড়ে গেলে তারা ধরে সোজা থানায় নিয়ে যায়। এরপর কোর্টে চালান দেয়। তখন কাজের দুই দিন তো যায়ই, সঙ্গে আরও দুই হাজার টাকা খরচ হয়।’ এভাবেই চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে নিজের জীবিকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন রাজধানীর নীলক্ষেত বই মার্কেটের বিক্রেতা জসীমউদ্দিন। ৩৫ বছর ধরে নীলক্ষেতের ফুটপাতে বইয়ের ব্যবসা করছেন তিনি।
জসীমউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার সময় সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে আসছিল। সেই শব্দ শুনেই সতর্ক হয়ে গেলেন জসীমউদ্দিন। ঘাড় ঘুরিয়ে বুঝতে চাইলেন কোন দিক থেকে সাইরেনের শব্দ হচ্ছে, তা বুঝতে পারেননি। তবু দোকানটা আধখোলা অবস্থায় রেখেই দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলেন। সেখান থেকেও সাইরেনের উৎস খুঁজলেন। কিন্তু সাইরেনের শব্দ শোনা গেলেও অ্যাম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটা আর সেদিকে আসেনি। ফলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে ফেলতেই যেন দোকানে ফিরে এলেন।
জসীমউদ্দিনের আশপাশে বসা ফুটপাতের দোকানি ও মার্কেটের ব্যবসায়ীদের অবস্থাও যে একই রকম, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন নীলক্ষেতে আসেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে ফুটপাতে বা গলিপথে হেঁটে, পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে কিংবা এদিক-ওদিক পায়চারি করে ক্রেতা আসার অপেক্ষায় থাকেন। মাঝেমধ্যে পুলিশও বিধিনিষেধে দোকানপাট খোলা কি না, তা তদারক করতে আসে। তখন দোকানিরা সবাই যে যাঁর মতো সরে পড়েন বা পালিয়ে যান।
দোকানিদের কথা, এক বছর ধরে দেশে সব স্কুল-কলেজ বন্ধ। কোনো পাবলিক পরীক্ষা হচ্ছে না। কিছু কিছু চাকরির পরীক্ষা হলেও সেই উপলক্ষে বেচাবিক্রি তেমন হয় না। সব মিলিয়ে বইয়ের ব্যবসা একদমই বসে গেছে।
করোনার আগে দৈনিক আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার বই বিক্রি করতেন জসীমউদ্দিন। তাতে ৭০০-৮০০ টাকা করে মুনাফা থাকত। মাসে আয় হতো ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। সেই আয়ে বেশ ভালোই কাটত দিন। কেরানীগঞ্জে আট হাজার টাকা বাড়িভাড়া দিয়ে থাকতেন। চার কন্যার তিনজন স্কুল-কলেজে পড়ে। করোনার শুরুতে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে অনলাইনে পড়াশোনা শুরু হলে তিনি রাউটার কিনে বাসায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন লাগিয়ে দেন। এখন ব্রডব্যান্ডের খরচও চালাতে কষ্ট হচ্ছে। একমাত্র মুঠোফোন দিয়ে তিন মেয়ে পালা করে ক্লাস করছে। জসীমউদ্দিন বলেন, ‘এর চেয়ে বেশি কিছু করার সামর্থ্য আমার আর নেই। বাড়িভাড়াও জমে গেছে চার মাসের। সরকার যদি দু-চার ঘণ্টাও দোকান খোলার অনুমতি দিত, তাহলে হয়তো বেঁচে যেতাম।’
নীলক্ষেত্রের বই বিক্রেতারা জানান, গত বছর করোনার শুরুতে যখন সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, তখন তাঁদের বই অনলাইনে বিক্রি করে দিতেন কিছু ছাত্রছাত্রী। এভাবে কিছু টাকা আসত। এ বছর সেই বিক্রিও নেই। অনলাইনে কেউ বই কিনছেন না। একজন দোকানি বলেন, ‘আমাদের বইয়ের ক্রেতারা সব মধ্যম আয়ের মানুষ। করোনায় তাদের আয়ও কমে গেছে। বই কিনবে কোথা থেকে?’
এরই মধ্যে চলে আসে পুলিশের একটি গাড়ি। একজন ভ্রাম্যমাণ বিড়ি-সিগারেট বিক্রেতা ও একজন মুচিকে রাস্তার ওপার থেকে ধরে এনে ভ্যানে তোলে পুলিশ। সেদিক থেকে চোখ ঘোরাতেই দেখা গেল, জসীমউদ্দিনসহ যে দু-তিনজন বই বিক্রেতার সঙ্গে এতক্ষণ কথা হচ্ছিল, তাঁরা সবাই উধাও। পুলিশ ভ্যান যতক্ষণ ছিল, দোকানিদের কাউকেই দেখা গেল না। পুলিশ ভ্যান চলে যেতেই আবার সবাই এসে হাজির।
এবার গলায় বিরক্তি চেপে বলেন, ‘এবার যান তো, আপা। আপনি থাকলে ক্রেতা এসেছে ভেবে পুলিশ বারবার আসবে। প্লিজ, আপনি দয়া করে চলে যান।’