বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় টাকার মান কমিয়েছে। ফলে প্রতি ডলারের দাম দাঁড়াল ৮৬ টাকা ২০ পয়সা।
বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় টাকার মান কমিয়েছে। গত মঙ্গলবার প্রতি ডলার মার্কিন ডলারের দাম ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হবেন। অন্যদিকে আমদানিকারকদের খরচ বাড়বে। এর আগে জানুয়ারি মাসের শুরুতে ডলারের মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকাররা বলছেন, ডলার নিয়ে দেশের মুদ্রাবাজার এখন অস্থির। সরবরাহ নেই, চাহিদা তুঙ্গে। এটা শিগগিরই কমার কোনো লক্ষণও নেই। এর প্রভাব পড়বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুতে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো টাকার সমস্যায় পড়ছে।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে প্রবাসী আয় কমছে। এতে দেশের মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস জুলাই-জানুয়ারিতে ঋণপত্র খোলার হার (এলসি) বেড়েছে ৪৯ শতাংশ ও ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে ৫২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এতে ডলারের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। আর জুলাই-ফেব্রুয়ারি আট মাসে প্রবাসী আয় কমেছে ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অবশ্য রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ।
এভাবে ১০-২০ পয়সা করে ডলারের দাম না বাড়িয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট
জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী বলেন, পণ্যের মূল্য ও পরিবহনভাড়া অনেক বেড়েছে। এই
কারণে আগের চেয়ে অনেক বেশি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে। এর ফলে ডলারের দামও বাড়ছে। তবে জোগান ও চাহিদার ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারণ হলেই ভালো।
আরফান আলী আরও বলেন, বড় করপোরেটরা ঋণপত্রের দায় পরিশোধে বিলম্ব সুবিধা নিচ্ছে। এর ফলে তাদেরও খরচ বাড়ছে। ব্যাংকও চাপে পড়ে যাচ্ছে। সামনে ডলারের দাম বাড়লে বিপদ আরও বাড়বে।
ব্যাংকার ও আমদানিকারকেরা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের চাহিদা বেশ বেড়েছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন ডলার বিক্রি করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার ৪ কোটি ডলার ও গতকাল বুধবার ৮০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরে গতকাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াল প্রায় ৩৭৮ কোটি ডলার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে বিক্রি করে, সেটাকেই ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম হিসেবে ধরা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ডলারের মূল্য ৮৬ টাকা ২০ পয়সা হলেও ব্যাংকগুলো কিন্তু ৮৮-৮৯ টাকায় ডলার কেনাবেচা করছে। সেই দামে আমদানি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। খোলাবাজারে ডলার তো ৯০ টাকা ছাড়িয়েছে বেশ আগেই। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) ২১৬ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে নেমে আসে। তবে এখন আবার বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, এই সময়ে বিদেশি আয় ধরতে টাকার মান আরও কমাতে হবে। তাতে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় এবং পণ্য-সেবা রপ্তানি আয় বাড়বে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে ১০-২০ পয়সা করে ডলারের দাম না বাড়িয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক খুব ধীরে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটা আরও সময়োপযোগী হলে দেশের জন্য ভালো হয়।
আহসান মনসুর আরও বলেন, প্রবাসীরা এখন পকেটে ভরে দেশে ডলার নিয়ে আসছেন। এ জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে আয় কমেছে। প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসী আয় বাড়ানো যাবে না। এটি তুলে দেওয়া উচিত। কারণ, খোলাবাজারে বিক্রি করলে প্রতি ডলারে পাঁচ টাকা বেশি পাওয়া যায়। পার্থক্যটা এক টাকায় নামিয়ে আনতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত জানুয়ারি থেকে প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার, যা আগে ছিল ২ শতাংশ।