গত ডিসেম্বর মাসে এক কেজি প্যাকেটজাত লাল আটার দাম ছিল ৩৮ টাকা। নতুন বছরের প্রথম মাসেই তা হয়ে গেছে ৪৮ টাকা। গত কয়েক মাসে আটার মতো সব প্যাকেটজাত খাবারের দামই (বিধিনিষেধের পর থেকে) বেড়েছে।
সেই সঙ্গে সবজির দাম সারা বছরই ছিল চড়া। এখন ভরা শীতের মধ্যেও ভালো মানের লাউয়ের দাম ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটু বড় সাইজের ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। ভালো মানের শিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ টাকায়।
বাস্তবতা হলো মূল্যস্ফীতির হার গত এক বছরে কখনোই ৫ শতাংশের নিচে নামেনি। উন্নত দেশের মূল্যস্ফীতির সহনীয় হার ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও দেশে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫-এর ঘরে থাকলেই চাপ অনুভূত হয়। আর ডিসেম্বরে তা ৬-এর ঘর পেরিয়ে গেল।
এই বাস্তবতায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে টিসিবির ট্রাক ও খাদ্য অধিদপ্তরের বিক্রয়কেন্দ্রে বেড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড়। সেখানে যে বাজারের চেয়ে একটু কম দামে পণ্য পাওয়া যায়, তাই এত মানুষের ভিড়।
গত বছরের আগস্টে বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়তে থাকে। পরিবহনভাড়া তখন থেকেই বাড়তে শুরু করে। এর সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। এর প্রভাবে সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টির কারণেও সবজির দাম দফায় দফায় বেড়েছে, আবার কখনো কখনো কিছুটা কমেছে।
এ বাস্তবতার সঙ্গে আরেকটি প্রসঙ্গ যোগ করা যাক। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের জন্য বাংলাদেশের প্রধান ঝুঁকি হচ্ছে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করায় সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এ বিধিনিষেধ আরও কঠোর হলে নিম্ন আয়ের মানুষেরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
মহামারিতে মানুষের আয় কমেছে, অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন—বেড়েছে দারিদ্র্য। ২০২০ সালের জুনে বিআইডিএসের এক গবেষণায়ও বিষয়টি উঠে আসে। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থার জরিপে যা দেখা গেছে, তার সারসংক্ষেপ এরূপ: শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশি। এ ধাক্কা সামলাতে অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়েছেন। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় না থাকার কারণে আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালিয়েছেন তাঁরা। একেবারে যাঁরা দুস্থ, তাঁরা সমাজের বিত্তবান মানুষের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করেছেন।
প্রায় দুই বছর ধরে এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নতুন বিধিনিষেধ। সীমিত পরিসরে বিধিনিষেধ শুরু হয়ে গেছে। পরিস্থিতির আরও অবনিত হলে সরকার কঠোর বিধিনিষেধের দিকেও যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সায়েমা হক বলেন, এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, যাতে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব না পড়ে এবং নিম্ন আয়ের, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের ক্ষতি না বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ওএমএস বা রেশনের মাধ্যমে সুলভমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানোর মাধ্যমে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো এবং নতুন দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বেষ্টনীর আওতায় আনার বিকল্প নেই বলে সায়েমা হক মনে করেন।
সায়েমা হক আরও বলেন, কর্মসংস্থান চাঙা করার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নীতিনির্ধারণের মূল বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত।
চলমান বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঠিক উচ্চ চাহিদার কারণে নয়, ঘটছে সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটার কারণে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্বালানির তেলের মূল্যবৃদ্ধি। কয়েক দফা বিধিনিষেধের কারণে মানুষের চাহিদা অপূর্ণ আছে। এ কারণে চাহিদাজনিত চাপ কিছুটা আছে, তবে সেটা শিগগিরই মিটে যাবে বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ আরও কিছুদিন থেকে যাবে বলেই ধারণা করা যায়।
উন্নত বিশ্বের মতো সরকার এখনো কিছু প্রণোদনা দিচ্ছে। রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এতে রপ্তানিকারকদের সুবিধা হলেও আমদানিকারকদের ব্যয় বেড়ে যাবে। চাল, ডাল, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, শিশুখাদ্য, মসলা, গম, বিদেশ ভ্রমণ ও বিদেশে চিকিৎসার খরচ বাড়বে। সঙ্গে কিছু খাতে ভর্তুকিও আছে। অর্থাৎ সরকার এখন অর্থনীতি সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতি আরও কিছুদিন বাড়তি থাকবে বলেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। তবে বিশ্বজুড়ে আবারও লক ডাউন দেওয়া হলে জ্বালানি তেলের দাম কমতে পারে। তখন মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট তীব্র হলে শোচনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়।
২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে যেমন শহরের রাস্তায় ভুখা মানুষের দীর্ঘ মিছিল দেখা গেছে, তার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। এ বাস্তবতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি ও গরিব মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।