সামাজিক সুরক্ষা

গরিবের জন্য বাড়ল ১৮৭৮ কোটি টাকা

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে পেনশন, সুদ, কৃষি ভর্তুকি বাদ দিলে কোভিড প্রেক্ষাপটেও গরিবের জন্য প্রকৃত অর্থে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১,৮৭৮ কোটি টাকা।

জাতীয় বাজেট
প্রথম আলো

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মোট বরাদ্দের প্রায় ৩৯ শতাংশ খরচ হবে সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন, সঞ্চয় সুদ ও কৃষি ভর্তুকিতে। এই তিন খাতের বরাদ্দ বাদ দিলে নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমেছে।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ বা ৬৪ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তায়। আর আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে গরিব মানুষের জন্য খরচ হবে জিডিপির ১ দশমিক ৯ শতাংশ বা ৬৬ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোভিডের প্রেক্ষাপটেও সামাজিক নিরাপত্তায় পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও অক্সফামের যৌথ উদ্যোগে অনলাইনে অনুষ্ঠিত এক সংলাপে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। ‘কোভিডকালীন এই বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের জন্য কী আছে’ শীর্ষক এই সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

কোভিড-১৯ এবং কর্মসংস্থান নিয়ে সিপিডি ও অক্সফামের করা এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, করোনার কারণে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তাঁরা গড়ে ৯৫ দিনের মতো কাজ পাননি। পরে অবশ্য তাঁদের অনেকেই কাজে ফিরেছেন। তবে তাঁদের আয় গড়ে ১৩ শতাংশ কমেছে।

সংসদে বাজেট আলোচনা এক ধরনের নাটক। একজন সাংসদের জন্য ১০ মিনিট সময় দেওয়ার কোনো মানে নেই।
রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, করোনার কারণে সরকার সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে নানামুখী প্রণোদনা কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো চাল বিতরণ, নগদ টাকা প্রদান এবং বিশেষ নগদ সহায়তা। জরিপের উত্তরদাতাদের মধ্যে যাঁদের আয় কমেছে, তাঁদের ৭৭ শতাংশই ওই তিনটি সহায়তার একটিও পাননি। এ ছাড়া অতিদরিদ্রদের মাত্র ২৫ শতাংশ চাল ও নগদ সহায়তা (২ হাজার ৫০০ টাকা) পেয়েছেন। গ্রামের চেয়ে শহরের অতিদরিদ্ররা এই সুবিধা বেশি পেয়েছেন। প্রবন্ধে আরও বলা হয়, নতুন বাজেটে গতানুগতিক কাঠামোর মধ্যেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় অভীষ্ট মানুষেরা বাদ পড়ে যাচ্ছেন, অন্যরা ঢুকে পড়েছেন। আর কোভিডকালে নতুন গরিব বেড়েছে। নতুন গরিব ও পুরোনো গরিব—দারিদ্র্যের এই পরিসংখ্যান এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। মানুষ কতটা ঝুঁকিমুক্ত আছে, সেটাই বড় কথা। তিনি গরিব মানুষ ও দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা বিবেচনা করে গরিব মানুষের জন্য বিমা সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।

সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শুভংকরের ফাঁকি আছে। এগুলো হলো বরাদ্দের চেয়ে বেশি দেখানো হয়, সুবিধাভাগীরা যত টাকা পাওয়ার কথা, তা দেওয়া হয় না এবং প্রকৃত সুবিধাভোগীও চিহ্নিত করা হয় না।

বাজেট আলোচনা নাটক’

সংসদে বাজেট আলোচনাকে এক ধরনের ‘নাটক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, সাংসদেরা নিজেদের এলাকার প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। প্ল্যাকার্ড নিয়ে সাংসদ সংসদে কথা বলেন। বাজেট আলোচনায় একজন সাংসদকে ১০ মিনিট সময় দেওয়ার কোনো মানে নেই।

রেহমান সোবহান বক্তব্যের একপর্যায়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংসদ রাশেদ খান মেনন ও আলী আশরাফের কাছে জানতে চান, তাঁরা সংসদে বাজেট আলোচনায় কত মিনিট সময় পান? জবাবে রাশেদ খান মেনন ১০ মিনিটের মতো সময় পান বলে জানান।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বাজেট নাটক কি না, জানি না। একটি মঞ্চ থাকে, সেখানে গিয়ে আমরা হাজির হই। বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা অর্থহীন। আলোচনা করতে হয় বলেই করি। ১০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকলে কী হয়, একটি পয়েন্ট আলোচনা করতেই ১০ মিনিট চলে যায়।’ তিনি মনে করেন, বাজেট অনেকটা আমলানির্ভর হয়ে গেছে।

সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও সাংসদ আলী আশরাফ মনে করেন, তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনা করেই বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত।

অন্যান্য আলোচনা

করপোরেট কর দিয়ে সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ আছে বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, করোনার সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কোনো কর্মী ছাঁটাই করবে না, আবার নতুন কর্মী নিয়োগ দেবে, তারা করে ছাড় পাবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক লায়লা আশরাফুন বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিতে হবে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আশিকুর রহমান মনে করেন, এ দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোয় শহরের গরিবদের উপেক্ষা করা হয়।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বরিশাল শাখার নেত্রী মনীষা চক্রবর্তী প্রমুখ।