আগের অর্থবছরে স্বাস্থ্য গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ২০ গুণ বাড়িয়ে শতকোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
গবেষণা করার জন্য টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, আর এ টাকা খরচ করবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় দুটির প্রস্তুতির অভাবে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে পারেননি কেউই। ফলে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে গবেষণার জন্য বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা পড়ে আছে।
কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর গত বছর স্বাস্থ্য খাতের দুর্বল অবস্থা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। দেশের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভগ্নস্বাস্থ্যের চেহারা তখন ভেসে ওঠে সবার সামনে। বিশেষজ্ঞরাও প্রশ্ন তোলেন, এ খাতে ব্যাপক গবেষণা দরকার, কিন্তু এ জন্য তেমন কোনো অর্থই বরাদ্দ রাখা হয় না। এরপরই ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের গবেষণার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ কোটি টাকা। নামকাওয়াস্তের এ বরাদ্দ নিয়ে কথা উঠলে অর্থ মন্ত্রণালয় গবেষণার বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করে। কিন্তু দুই মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েনে খরচ হয়নি বরাদ্দের এক টাকাও।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব বুঝেই গবেষণায় এত টাকা বরাদ্দ দিলেন। আমলাতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণে টাকা খরচ না হওয়ার চেয়েও বড় দুঃখের জায়গা হচ্ছে গবেষণাটা হলো না। অথচ কোভিড নিয়েই গবেষণার অনেক কিছু ছিল, এখনো আছে।
কেন খরচ হলো না
কেন এমন হলো—তার নেপথ্য কারণ জানতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরও তহবিলটির নীতিমালা জারি করতে স্বাস্থ্যপক্ষ ফেলে রেখেছে চার মাসের বেশি। কারণ, এ টাকা ব্যবহারের সক্ষমতা নেই তাদের। আর স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের বক্তব৵ হচ্ছে, নীতিমালার খসড়াই করেছে তারা পাঁচ মাস পর। এ ছাড়া না বুঝে তাদের কাজ করতে গেছে অর্থ বিভাগ, আর জটিলতার শুরু ওখান থেকেই। এটিকে নতুন করেও করতে হয়েছে। অর্থাৎ দুই মন্ত্রণালয়ের পদ্ধতিগত সমস্যার কারণে বরাদ্দ পড়ে রয়েছে বরাদ্দের জায়গায়। টাকা খরচ হবে কীভাবে—এ বিষয়ে কোনো নীতিমালাই ছিল না এত দিন।
সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিলের কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কিত নীতিমালা অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অর্থ বিভাগ একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করে ২০২০ সালের নভেম্বরে। ৩ ডিসেম্বর এতে স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থ বিভাগের বাজেট অনুবিভাগ এরপর ৯ ডিসেম্বর নীতিমালাটি জারির জন্য অনুরোধ করে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ সচিবের কাছে চিঠি পাঠায়। সেই থেকে চার মাস বিভাগটি নীতিমালা জারি না করে ফেলে রেখেছে। কিছু যোজন-বিয়োজন করে গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ নীতিমালাটি জারি করে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার তিনটি দিক—স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য গবেষণা। এর মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলেও চিকিৎসাক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা এবং নতুন উদ্ভাবনী শক্তির সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি।
গবেষণায় রাখা ১০০ কোটি টাকা খরচ না হওয়ার পেছনে অর্থ বিভাগের দায় আছে—এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল রোববার অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের কার্যালয়ে গেলে তাঁর একান্ত সচিব মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, সচিব তাঁকে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবু ইউছুফ। আবু ইউছুফ অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণসচিব মো. আলী নূর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নীতিমালার খসড়াটি অর্থ বিভাগ করেছে। আমাদের কাছে আসার পর এর ওপর কাজ করতে হয়েছে। এটা ঠিক যে করোনার কারণে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে এখন থেকে এটা দ্রুতই এগোবে।’
যেসব বিষয়ে গবেষণা করার সুযোগ
নীতিমালায় বলা হয়েছে, যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি, সেসব বিষয়ে গবেষণায় উৎসাহিত করা হবে এবং তহবিল থেকে অনুদান দেওয়া হবে। এর মধ্যে শুরুতেই রয়েছে জনস্বাস্থ্য। এ ছাড়া রয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের আওতায় সংক্রামক ব্যাধি করোনাভাইরাস, চিকুনগুনিয়া, ইবোলা ভাইরাস, জিকা ভাইরাস ও অন্যান্য ভাইরাস। নন-কমিউনিকেবল রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, অটিজম ও মেন্টাল ডিজঅর্ডার, ট্রমা ও ইনজুরি ইত্যাদি বিষয়েও গবেষণা করা যাবে। নির্দিষ্ট কোনো রোগ নিয়ে জরিপের পাশাপাশি স্বাস্থ্য প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা নিয়েও গবেষণা করার পথ খোলা রাখা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নীতিমালায় গবেষণার জন্য স্বাস্থ্য অর্থনীতিকে রাখা হয়নি, যা বিস্ময়কর। মনে হচ্ছে নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য অর্থনীতির গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা কম।’ তবে তহবিল গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সৈয়দ আবদুল হামিদ আরও বলেন, ‘অর্থবছর তো প্রায় শেষ। আশা করছি আগামী অর্থবছরেও এ বরাদ্দ থাকবে। এখন দরকার হচ্ছে স্থায়ী একটি দপ্তরের মাধ্যমে তহবিলটির সদ্ব্যবহার করা। সে জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করতে হবে।’
নীতিমালায় না থাকলেও স্বাস্থ্য অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করা যাবে বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষাসচিব মো. আলী নূর। প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজনে এ জন্য নীতিমালায় সংশোধনী আনা হবে।
গবেষকদের বাছাই ও নির্বাচন কীভাবে
গবেষক বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হবে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। আবেদনকারী হবেন বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশেই গবেষণা করতে হবে। আবেদনকারীকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট বা স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, জনস্বাস্থ্য, পুষ্টিবিদ, মৌলিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা গবেষক হতে হবে।
প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। সরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও আবেদন করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে আবেদনকারী গবেষণার জন্য দেশ-বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা নেননি বলে অঙ্গীকারনামা দিতে হবে। আবেদনকারীর বয়স হবে সর্বোচ্চ ৬০ বছর। তবে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সুনাম বিবেচনায় বয়সসীমা শিথিলযোগ্য। একজন আবেদনকারী দুটি গবেষণা প্রস্তাব দিতে পারবেন।
গবেষণা প্রস্তাব বাছাইয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমানকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি বছরে দুবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বাছাইয়ের পর তালিকা পাঠাবে ১১ সদস্যের জাতীয় কমিটির কাছে। জাতীয় কমিটির সভাপতি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক কাজী দ্বীন মোহাম্মদ। জাতীয় কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত মতামত দেবে এবং এর ৭ দিনের মধ্যে নির্বাচিতদের জানিয়ে দেবে। গবেষণার কাজ শেষ করতে হবে দুই বছরের মধ্যে। অনুদান দেওয়া হবে তিন কিস্তিতে।
জাতীয় কমিটির সভাপতি কাজী দ্বীন মোহাম্মদ এ নিয়ে ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেরি তো হয়েই গেছে। আসলে কোভিডের কারণে চিকিৎসকেরা সবাই ব্যস্ত। তারপরও দুটি বৈঠক করেছি। আগামী সপ্তাহে আরেকটা বৈঠক হবে। এরপর বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’