খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন নীতির প্রশ্নে আপসহীন। নির্মোহ ও সত্য কথাবলতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। অন্যায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে কখনো দল ও ব্যক্তি বিবেচনা করতেন না। ব্যাংকার হিসেবে কৃষি, অগ্রণী, সোনালী ও পূবালী ব্যাংকের এমডি ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। গতকাল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন একজন বিশ্বস্ত, দক্ষ এবং জ্ঞানী সহকর্মী। নীতির প্রশ্নে সব সময় ছিলেন আপসহীন। আর্থিক খাতে ওনার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তা ছাড়া এ দেশের কিশোর সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যে কচি-কাঁচার আসর কাজ করছে, তারও পরিচালক হিসেবে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। ইব্রাহিম খালেদ ভালো বলতেন, ভালো লিখতেন। সত্য কথা বলতে কখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েননি। নিঃসংকোচে সত্য বলার সাহস ও গুণের কারণে তিনি অনন্য উচ্চতায় উঠে গেছেন। আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে পেয়েছি। সেখানেওতিনি শক্ত ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর ডেপুটি গভর্নর হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় পূবালী ব্যাংক একজন ভালো ব্যাংকার খুঁজছিল। ব্যাংকটি ভালো হওয়ার চেষ্টা করছিল। তিনি সমস্যাগ্রস্ত পূবালী ব্যাংকের এমডি পদে যোগদান করেন। ব্যাংকটিকে একসময় সুস্থ ধারায় ফিরে আনেন। আমি মনে করি, কর্মই ইব্রাহিম খালেদকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
আমি গভর্নর থাকাকালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন পূবালী ব্যাংকের এমডি। উনি পূবালী ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকটির অবস্থা ভালো ছিল না। ছয় বছরে তিনি ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করে ফেলেন। যা তাঁর পরিচিতি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন আর্থিক খাতের বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। খুব সাহসী মানুষ ছিলেন। কোনো ব্যক্তি, দল বিবেচনা করে কথা বলতেন না। সততার সঙ্গে চলেছেন। এ জন্যই উনি সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে সবাই সব কথা বলতে যখন দ্বিধায় রয়েছেন, উনি তখন নির্ভয়ে বলে যেতেন। তিনি যেসব বক্তব্য ও মতামত দিয়ে গেছেন, তা অনুসরণ করলেই তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে। এটাই হবে তাঁর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা। এতে আর্থিক খাতের পাশাপাশি পুরো দেশ উপকৃত হবে। আমি পিকেএসএফ থেকেই তাঁকে চিনতাম। ব্যক্তিজীবনে তিনি সততার সঙ্গে চলেছেন, যা বর্তমান সময়ে খুবই বিরল।
মইনুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। ১৯৯৩ সালে আমি যখন অর্থনীতি সমিতির সহসভাপতি ছিলাম, তখন উনি নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। তখন থেকেই আমাদের পরিচয়ের সূত্রপাত। এরপর আমি যখন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ছিলাম, তখন উনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর। তিনি আমার বড় শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। খেলাপি ঋণ নিয়ে তিনি সব সময়ই সাহসী বক্তব্য দিতেন। তিনি নির্দ্বিধায় সত্যি কথা বলতেন। এ জন্য তিনি সরকারের কোনো কোনো মহলে বৈরী মনোভাবের শিকার হয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন সেই সব ঋণ খেলাপিদের অনেকে অত্যন্ত প্রভাবশীল হয়ে গেছেন, সরকারের অংশ হয়ে গেছেন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বর্তমান সরকারের বড় শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কিন্তু সরকার কোনো ভুল করলে তার প্রতিবাদ করতেন। আমি নিজেও ঋণখেলাপি, বিদেশে অর্থ পাচার—এসব নিয়ে অনবরত বলে যাচ্ছি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদও এসব বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। আমরাই ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারের মতো বিষয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি।
হেলাল আহমেদ চৌধুরী, সাবেক এমডি, পূবালী ব্যাংক
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ২০০৬ সালে পূবালী ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অবসরে যান। এরপরই আমি ওই ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পাই। এর আগে ওনার সহকর্মী হিসেবে প্রায় ছয় বছর কাজ করার সুযোগ হয়। উনি সব সময় ন্যায়নীতির মধ্যে থাকার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির কীভাবে উন্নতি ঘটবে, সে চিন্তাও করতেন। ব্যাংক খাত যে অর্থনীতির প্রাণশক্তি, এটা উনি ভালোভাবে অনুধাবন করতেন। সেভাবেই ব্যাংক নিয়ে পরিকল্পনা করতেন। উনি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। এমনকি তাঁর সঙ্গে থাকা কাউকে জেনে–বুঝে অন্যায় করতে দেননি।
কসঙ্গে কাজ করার সুবাদে আমি দেখেছি, ওনার মধ্যে শিক্ষকসুলভ মনোভাব ছিল। যখন আমরা ঢাকার বাইরে কোথাও যেতাম, তখন কোনো প্রশ্ন করলে পুরো পথে এ নিয়ে আলোচনা করতেন। এর ফলে তাঁর থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি ও জেনেছি। ওনার যে সততা ও প্রজ্ঞা ছিল, তা পুরো আর্থিক খাতে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে।