করোনায় গুটিয়ে গেছে বিউটি পারলার

করোনার সংক্রমণ রোধের অন্যতম উপায় হলো সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। কাউকে ছোঁয়া বা স্পর্শ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। সে জন্যই বিউটি পারলারের ব্যবসায় ধস নেমেছে। কারণ, গ্রাহকের শরীরে স্পর্শ না করে তো কাজ করতে পারেন না বিউটি পারলারের কর্মীরা। এর উল্টোও বলা যায়, করোনার ভয়ে নারীরা এখন আর বিউটি পারলারে যান না। দুটো কথার একটাই পরিণতি, পারলারের কর্মীদের কোনো আয়-রোজগার নেই। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তাঁরা। একইভাবে বিউটি পারলারের মালিকেরা লাখ লাখ টাকার পুঁজি বিনিয়োগ করেও বেশ বিপাকে রয়েছেন।

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় কিংবা জেলা শহরই নয় শুধু, উপজেলা কিংবা মফস্বল শহরগুলোতে গড়ে ওঠা বিউটি পারলারগুলোও এক বছরের বেশি সময় ধরে কার্যত বন্ধ রয়েছে। বিউটি পারলারে কর্মরত নারীদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির বিষয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান উজ্জ্বলার এক জরিপে বলা হয়েছে, গত বছর করোনা আঘাত হানার ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশের বিউটি পারলার খাতে প্রায় ৪০ শতাংশ নারী কাজ হারিয়েছেন। বিউটি পারলারের ব্যবসা সংকুচিত হয়েছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। দুই সপ্তাহ ধরে চলা নতুন লকডাউনের কারণে বাকি থাকা ব্যবসারও টিকে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

একক শিল্প খাত হিসেবে বিউটি পারলার স্বীকৃতি পেয়েছে মাত্র গত বছর জুনে। তবে এই খাতে ঠিক কতজন কাজ করেন বা কয়টি প্রতিষ্ঠান আছে, তা নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সঠিক জরিপ নেই।

২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) করা এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন উদ্যোক্তার একজন বিউটি পারলার ব্যবসায় জড়িত। করোনার আগে সব মিলিয়ে দেশে এই খাতে প্রায় আট লাখ প্রতিষ্ঠান কাজ করত। তাদের মোট বার্ষিক আয় ছিল ৫০০ কোটি টাকার মতো।

নাসরীন আক্তার নামের এক নারী উদ্যোক্তা প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ করে ২০১৯ সালে ঢাকার বকশীবাজারের বদরুন্নেসা কলেজের সামনে একটি বিউটি পারলার খুলেছিলেন। গত বছর করোনার প্রথম তিন মাস তাঁর পার্পেল বিউটি পারলার একদম বন্ধ থাকে। পরে খোলার অনুমতি পেলেও গ্রাহক খুব একটা আসছিল না। বাড়িভাড়া আর কর্মীদের খরচও উঠছিল না। এভাবে বেশ কয়েক মাস চলার পর এ বছরের জানুয়ারিতে তিনি ব্যবসা বন্ধ করে দেন। তবে তিনি ঈদের আগে আবার পারলার চালু করার আশায় ছিলেন। কিন্তু সরকার দুই সপ্তাহের লকডাউনে সবকিছু বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়ায় নাসরীন আক্তারের সেই আশার গুড়ে বালি।

উত্তরায় এ রকমই বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি পারলারে কাজ করতেন তামান্না ইসলাম। কাজ হারিয়ে নিজ উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের রূপচর্চার কাজ করছিলেন। কিন্তু গত মার্চের শুরুতে আবার যখন করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করে, তখন তাঁর গ্রাহক কমে যায়। কাজ হারিয়ে তাই বরিশালে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন তামান্না। কোনোক্রমে ধারদেনা করে চলছেন এখন। মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভেবেছিলাম ঈদের সময় ফিরে আসব, কাজ পাব। এখন আর কোনো আশা দেখছি না। জানি না সামনে কী করব।’

করোনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক উদ্যোক্তা ৪ শতাংশ সুদে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ পেলেও অধিকাংশ বিউটি পারলার ও স্যালনমালিক তা পাননি বলে অভিযোগ আছে। যাঁরা পাননি, তাঁরা ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকতে চাইছেন।

করোনার প্রথম ধাক্কায় যেসব বিউটি পারলারের কর্মী চাকরি হারাননি, তাঁদের অনেকেই দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে দেওয়া লকডাউনের কারণে বিপদের আশঙ্কায় রয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই বেতন কমেছে। কেউ কেউ আবার মাসিক বেতনের পরিবর্তে কাজের ওপর একটা হিস্যা পাচ্ছেন, যা দিয়ে জীবন চলছে না। তাই বাধ্য হয়ে কারও কারও পেশা বদলানোর খবর শোনা যায়।

যেসব স্যালন বা বিউটি পারলার এখনো টিকে আছে সে রকম কয়েকটির মালিক প্রথম আলোকে জানান, মাস শেষে বড় অঙ্কের বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে হয়। এতে তাঁরা ঋণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছেন।

করোনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক উদ্যোক্তা ৪ শতাংশ সুদে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ পেলেও অধিকাংশ বিউটি পারলার ও স্যালনমালিক তা পাননি বলে অভিযোগ আছে। যাঁরা পাননি, তাঁরা ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকতে চাইছেন।

জানতে চাইলে বিউটি সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএসওএবি) প্রেসিডেন্ট কানিজ আলমাস খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট-বড় যাঁর সঙ্গেই আমরা কথা বলেছি, তাঁরাই জানিয়েছেন, অন্তত এই সময়টায় টিকে থাকতে তাঁদের কিছু আর্থিক সহযোগিতা লাগবে।’

এদিকে উজ্জ্বলার সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফরোজা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু ঋণ নয়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরামর্শও দিতে হবে, যেন ঋণটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা সামনে এগোতে পারেন।