ইইউতে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ ২০২৯ সাল পর্যন্ত। এরপরই হবে সংকট। সে জন্য ওই সব দেশের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করার পরামর্শ।
দেশের কৃষি খাতের আধুনিকায়নে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই উন্নয়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয় সেমিনারে।
২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে কঠিন নীতিমালার মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে। এটি হবে মূলত পণ্যের রুলস অব অরিজিন বা উৎসবিধির ক্ষেত্রে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করা। যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও তা করতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ও ইউরোপের মধ্যকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচকেরা এসব কথা বলেছেন। সপ্তাহব্যাপী চলমান ‘বাংলাদেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২১’-এর দ্বিতীয় দিনে গতকাল বুধবার এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিন উদ-দৌলা। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। এ ছাড়া বক্তব্য দেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক, গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সিইও নাসের ইজাজ বিজয় ও ইউনিলিভার বাংলাদেশের সিইও জাভেদ আখতার।
প্রবন্ধে বলা হয়, অস্ত্র ছাড়া সবকিছু রপ্তানিতে বাংলাদেশ ইইউতে অগ্রাধিকারমূলক শুল্কসুবিধা (জিএসপি) পাচ্ছে এবং ২০২৯ সাল পর্যন্ত পাবে। ইইউতে প্রধান রপ্তানিপণ্য হচ্ছে ওভেন পোশাক, নিট পোশাক, ফুটওয়্যার, মৎস্য, খেলনা ইত্যাদি। কিন্তু জিএসপি প্লাস পেতে গেলে শ্রম, পরিবেশ ও শিল্প খাত সম্পর্কিত ২৭ ধরনের বিষয়ে উন্নতির দরকার পড়বে। উৎস বিধির ক্ষেত্রে কঠিন শর্তের মধ্যে পড়ার বিষয়টি তো আছেই। সেবা খাতে ইউরোপের দেশগুলোতে সন্তোষজনক রপ্তানি না থাকার কথা উল্লেখ করে আরও বলা হয়, সার্বিকভাবে এ দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বিত অংশীদারত্ব চুক্তির দরকার পড়বে।
দেশের কৃষি খাতের আধুনিকায়নে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই উন্নয়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয় সেমিনারে। বাণিজ্য বৃদ্ধি ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ারও প্রস্তাব দেওয়া হয় প্রবন্ধে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর ইইউর জিএসপি প্লাস কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে চাই। আপনাদের একটা খুশির খবর দিতে চাই যে গত মাসে ইইউর যে নতুন জিএসপি বিধির খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের জন্য একটি শর্ত ছাড়ের কথা বলা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের সরাসরি উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুশাসন (কমপ্লায়েন্স) নিশ্চিতে এখনই সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের তাগিদ দেন টিপু মুনশি। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য ইইউ-বাংলাদেশ বাণিজ্য সংলাপও করা হচ্ছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, চার দশকে দেশের তৈরি পোশাক খাতের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে ইইউ থেকে নতুন জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে কমপ্লায়েন্সের ওপর আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে তিনি পোশাক খাতে পণ্য বহুমুখীকরণের দরকার বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, হালকা প্রকৌশল খাতকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের বাণিজ্যের অন্যতম ব্যবসায়িক অংশীদার। অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে ইউরোপের বাজারে আরও বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি বলেন, ইউরোপের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে (ইপিজেড) ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
ইউনিলিভার বাংলাদেশের সিইও জাভেদ আখতার বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ বছরে গড়ে প্রায় ২৩ মার্কিন ডলারের ভোগ্যপণ্য গ্রহণ করেন। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বাজারকে আরও সম্ভাবনাময় করে তুলছে। বাংলাদেশ থেকে বেশি মুনাফা পেতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের সিইও নাসির এজাজ বিজয় বলেন, আর্থিক খাতের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের বাজার। এই খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে সফলভাবে মোকাবিলা করা গেলে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। বিদেশি উদ্যোক্তারা এসব সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারেন।