উচ্চ প্রবৃদ্ধি না মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কোন পথে মুদ্রানীতি

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির তেমন কোনো কার্যকারিতা নেই। এটি ঘোষণা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

বাংলাদেশ ব্যাংক

মুদ্রার বিনিময় হারের অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। গত মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারের লক্ষ্য, কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি। এ জন্য প্রয়োজন বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ বাড়ানো। আবার সরকারও ব্যাংক খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে চায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি। ফলে মুদ্রানীতিতে জিডিপি না মূল্যস্ফীতি, কোনটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে, তা ঠিক করা সহজ কাজ নয়।

এমন পরিস্থিতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা ৩০ জুন ঘোষণা করা হতে পারে। এবারের মুদ্রানীতি অনলাইনের পরিবর্তে সরাসরি ঘোষণা করবেন গভর্নর ফজলে কবির।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার সুদের হার নির্ধারণ করে রেখেছে। পাশাপাশি ডলারের দামও পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না। আবার সরকার ব্যাংক খাত থেকে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। ফলে মুদ্রানীতিতে বৈচিত্র্য দেখানোর কিছু নেই। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির বিষয়টি ভুলে গিয়ে জিডিপি অর্জনের জন্য যা করা প্রয়োজন, মুদ্রানীতিতে তাই থাকবে।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির তেমন কোনো কার্যকারিতা নেই। ঘোষণা দেওয়ার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। কারণ, নীতিনির্ধারণী সুদহারে শিগগিরই তেমন পরিবর্তন হয় না। আবার গত ২৯ মে রেপো সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে ব্যাংকগুলোর খরচ বেড়েছে। ২০২০ সালে জুলাইয়ে রেপো সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। করোনাভাইরাসের প্রকোপের শুরুতে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকার প্রবাহ হ্রাস করতে হচ্ছে।

দেশে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য, বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনক্ষমতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। এতে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অস্ত্র হলো মুদ্রানীতি। মুদ্রানীতির দুটি বাহক হচ্ছে সুদ আর বিনিময় হার। এর দুটোই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে নেই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য কোনো উদ্যোগও কাজে আসছে না। আবার এখন যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তা সরবরাহজনিত। ফলে দেশি উদ্যোগেও কাজে আসবে না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন জিডিপির সংখ্যা ভুলে গিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করা উচিত। এ জন্য বেসরকারি ঋণের প্রবাহ কমাতে হবে, সরকারকেও কম খরচ করতে হবে। আমদানিনির্ভর বড় প্রকল্পগুলোর গতি কমিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি সুদহার ও ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এমনিতেই চাহিদা কমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি জিডিপিকে প্রাধান্য দিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে, তাহলে বড় ভুল করবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে, যার মাশুল দিতে হবে পুরো দেশকে।’

জানা গেছে, চলতি জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত এপ্রিল পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সরকারি–বেসরকারি মিলে জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ১৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, এপ্রিল পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ফলে ব্রড মানির প্রবৃদ্ধি গত এপ্রিল পর্যন্ত বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ, যদিও জুন পর্যন্ত লক্ষ্য ১৫ শতাংশ।

এদিকে ডলারের দাম ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৯৩ ছুঁই ছুঁই। তবে আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম এখন ৯৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে মেয়াদি আমানতের সুদও বাড়াতে হবে। ফলে ব্যাংক পড়েছে বিপাকে। কারণ, ঋণের সুদ ৯ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। এমন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সময়োপযোগী নীতি আশা করছেন ব্যাংকাররা।

ব্যাংকাররা বলছেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ রয়েছে, যার বড় অংশ বিতরণ হয়েছে। এসব টাকা ব্যাংকে ফেরত আনা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এর পরিবর্তে আরও ঋণ দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করলে তা অর্থনীতির জন্য বুমেরাং হতে পারে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ বন্ধ করে এ খাত নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার বিনিময় হার এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত জিডিপি অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে।