দেশে গত এক যুগে যে হারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, সেই হারে কিন্তু সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি।
এক যুগ আগের কথা। ২০১০ সালের ৯ মার্চ রাজধানীর বাজারে এক কেজি মোটা চাল ২৬ টাকা, ডাল ৭৫ টাকা, খোলা আটা ২১ টাকা ও চিনি ৪৮ টাকা; এক লিটার খোলা পাম তেল ৬৫ টাকা ও ডিমের ডজন ৭২ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এটি সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাব।
ওই সময়ে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার চাকরিজীবী আবদুল্লাহ আল মামুনকে তিনজনের সংসার চালাতে মাসে ৩০ কেজি চাল, ৩ কেজি ডাল, ২ লিটার তেল, ৩ কেজি আটা, ১ কেজি চিনি, ২ কেজি পেঁয়াজ ও আড়াই ডজন ডিম কিনতে খরচ করতে হতো ১ হাজার ৪৬২ টাকা। এক যুগ পর ওই সাতটি নিত্যপণ্য কিনতে এখন তাঁর খরচ হয় ২ হাজার ৪৭৩ টাকা। অর্থাৎ এক যুগে খরচ বেড়েছে ৭০ শতাংশের বেশি। এ সময়ে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৭৭ শতাংশ।
এদিকে গত এক যুগে আবদুল্লাহ আল মামুনের সংসারে চাহিদাও বেড়েছে। নতুন অতিথি এসেছে। খরচের খাতায় বছর বছর নতুন নতুন খাত যুক্ত হয়েছে। ছেলে স্কুলে যাচ্ছে। সেখানেও খরচ বেড়েছে। এক যুগে আবদুল্লাহ আল মামুনের বেতন ১২ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু আয় বাড়লেও তা দিয়ে সংসারের চাকা ঘোরানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ আয় বাড়লেও তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় বড় সংখ্যা পাচ্ছি। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তার প্রতিফলন দেখছি না। যেমন তৈরি পোশাকশ্রমিকদের বেতন বেড়েছে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম তার তুলনায় বেশি বেড়েছে। বাড়তি আয়ের টাকা দিয়ে তাঁরা জীবনমান বাড়াতে পারছেন না।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ দেশে দারিদ্র্যসীমার আশপাশে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী বাস করেন। কোভিডের মতো সংকট কিংবা চাল, তেল, পেঁয়াজের মতো অতিনিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে ওই জনগোষ্ঠী অসহায় হয়ে পড়েন। তখন টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের লম্বা সারি দেখা যায়। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় বড় সংখ্যার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে করোনার প্রথম ধাক্কায় দেড় কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গিয়েছিল। বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের চাকরি থাকলেও আয় কমেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি জাতীয় মজুরি সূচক প্রকাশ করে। মজুরি সূচকের মাধ্যমে সেবা, শিল্প ও কৃষি খাতে মজুরি কী হারে বাড়ছে সেই চিত্র প্রকাশ করা হয়।
বিবিএসের মজুরি সূচকের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে মজুরি সূচক ছিল ১০০ পয়েন্ট, যা ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট। মানে হলো, ২০১০ সালে মানুষের গড় মজুরি যদি ১০ হাজার টাকা হয়, তাহলে ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার ৮৩০ টাকা। এক যুগে মজুরি বেড়েছে প্রায় ৮১ শতাংশের মতো।
অন্যদিকে বিবিএসের পুরোনো হিসাব অনুযায়ী, ২০০৫-০৬ সালে মূল্যস্ফীতি সূচক ছিল ১০০, যা প্রতি বছর বাড়তে বাড়তে ২০১০-১১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ১৫৬ পয়েন্ট। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সূচক ২৮৮ পয়েন্টে উন্নীত হয়। মূল্যস্ফীতির ভিত্তি পুনর্বিন্যাস করলে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সূচক যদি ১০০ পয়েন্ট হয়, তাহলে ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৪ পয়েন্ট। অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে যেখানে জিনিসপত্র কিনতে ১০০ টাকা খরচ হতো, সেখানে তা কিনতে এখন কমপক্ষে ১৮৪ টাকা খরচ হয়। এ সময়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৮৪ শতাংশ, যা মজুরি বৃদ্ধির (৮১ শতাংশ) চেয়ে খানিক বেশি। এর মানে হলো, মানুষের গড় মজুরি যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ গত এক যুগে মানুষের গড় ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।
গত এক যুগে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তিন গুণের বেশি বেড়েছে। যেমন ২০১০-১১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৮২৫ মার্কিন ডলার। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৯১ ডলারে। অবশ্য মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়; দেশের সব আয়কে সব মানুষকে ভাগ করে দেওয়া হলে প্রত্যেক নাগরিকের ভাগে যত টাকা পড়ে, সেটিই হলো মাথাপিছু আয়।
এক যুগে মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধির এই যাত্রায় বড় কয়েকটি অর্জন হয়েছে। যেমন বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। সে আলোকে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
আবার মাথাপিছু আয়সহ বিভিন্ন সূচকের উন্নতির ফলে জাতিসংঘের মূল্যায়নে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকেও বের হওয়ার পথে রয়েছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ পূর্ণমাত্রায় উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে।