দেশের সব শ্রেণির মানুষকে পেনশনের আওতায় আনতে সরকার একটি আইন করতে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছে। প্রস্তাবিত আইনটির নাম রাখা হয়েছে ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২২’।
অর্থ বিভাগ সাধারণত মতামতের জন্য কোনো আইনের খসড়া ওয়েবসাইটে আপলোড না করলেও আজ মঙ্গলবার জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়াটি আপলোড করেছে। অর্থ বিভাগ এখন মতামতের জন্য আলাদা করে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগেও আইনের এ খসড়া পাঠাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ পাওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই খসড়াটি তৈরি হয়েছে। তার আগে গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি কৌশলপত্র উপস্থাপন করে অর্থ বিভাগ। কৌশলপত্র উপস্থাপনের দিনই প্রধানমন্ত্রী আইন প্রণয়নের জন্য অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দেন।
কিন্তু বিভ্রান্তিতে ভরপুর আইনের খসড়াটিতে গরিব মানুষ কীভাবে পেনশন–ব্যবস্থার আওতায় আসবেন, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতাদের ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে।’ অনুদান যে সরকার দেবেই, সে কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে, দিতে পারবে, অর্থাৎ সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে বিষয়টি। অনুদান না–ও দিতে পারে সরকার।
‘দুস্থ চাঁদাদাতা’র সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এ রকম—‘পেনশন কর্মসূচিতে নিয়মিত চাঁদাদানকারী যিনি দুর্ঘটনা বা শারীরিক অসুস্থতাজনিত সমস্যায় স্থায়ীভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।’ নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিক কারা, সেই সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি খসড়ায়।
পেনশন কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি আইনের ধারা লঙ্ঘন করলে লঙ্ঘনের দায়ে ওই ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করার কথা বলা হলেও জেল-জরিমানা বা অন্য কোনো শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়নি এতে।
আইনের খসড়া বিশ্লেষণে দেখা যায়, কারা এ পেনশন–ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে। একবার বলা হয়েছে, ‘গেজেট প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থার বাইরে থাকবে।’ আবার বলা হয়েছে, ‘সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে পারবে।’ সরকারি-বেসরকারি সব চাকরিজীবীই এতে দ্বিধান্বিত আছেন।
সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থায় আসার বিষয়ে অর্থ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি একটু বিভ্রান্তিকর হয়েছে। মতামত আসার পর মন্ত্রিসভায় যে খসড়া পাঠানো হবে, তাতে কিছু যোজন-বিয়োজন করা হবে।’
ঋণ নেওয়া যাবে ৫০ শতাংশ
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, তহবিলে জমা করা অর্থ কোনো পর্যায়েই এককালীন তুলে নেওয়ার সুযোগ রাখা হবে না। তবে চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যাবে, যা নির্ধারিত ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। ফিসহ পরিশোধ করা অর্থ চাঁদাদাতার নিজের হিসাবেই জমা হবে।
১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী থেকে ৫০ বছর বয়সী পর্যন্ত সব বাংলাদেশি নাগরিক পেনশনের আওতায় আসতে পারবেন। এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরাও।
মৃত্যুর আগপর্যন্ত পেনশন
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থার আওতায় আসতে চাঁদা দেওয়া শুরু করা যাবে ১৮ বছর বয়স হলেই। কিন্তু বয়স ৬০ বছর না হলে পেনশন পাওয়া যাবে না। চাঁদাদাতা পেনশন পাবেন আজীবন, অর্থাৎ মৃত্যুর আগপর্যন্ত। তিনি মারা গেলে পরিবারের কেউ আর পেনশন পাবেন না। ৭৫ বছর বয়সের আগে চাঁদাদাতা মারা গেলে তাঁর নমিনি পেনশন পাবেন ৭৫ বছর হওয়া পর্যন্ত যে সময়টুকু বাকি থাকবে, শুধু সে সময়ের জন্য।
আইন পাসের পর একটি গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা চালু করবে। এ জন্য গঠন করা হবে একটি পেনশন তহবিল। তহবিল পরিচালনার জন্য গঠন করা ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ নামের একটি সংস্থা।
১০ বছর চাঁদা না দিলে পেনশন নয়
আরও বলা হয়েছে, মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে, যা জমা হবে পেনশন তহবিলে। অগ্রিম ও কিস্তিতে জমা দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকবে। আর প্রাথমিকভাবে এ ব্যবস্থা থাকবে ঐচ্ছিক। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলেই মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।
বয়স ৬০ বছর হওয়ার পর থেকে মাসিক পেনশন পাবেন চাঁদাদাতা। তবে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগেই চাঁদাদাতা মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ ফেরত দেওয়া হবে নমিনিকে। মাসিক পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।