আওতা বাড়ছে ভুলে ভরা তালিকা নিয়েই

কয়েকটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ছে। তবে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যে ত্রুটি রয়েছে, তা সংশোধন না হলে অর্থের অপচয় কমবে না।

জাতীয় বাজেট

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতের আওতায় ১২৩টি কর্মসূচি বা বিষয় রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলোর মধ্যে ৮টি কর্মসূচি হচ্ছে নগদ ভাতা, আর ১১টি খাদ্যসহায়তা। ভাতা ও সহায়তা দেওয়ার তালিকাগুলো অনিয়মে ভরা। সরকারই তা চিহ্নিত করেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সরকারের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএসএস) মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে অধিকতর কার্যকর করতে ২০১৫ সালে সরকার পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগের (জিইডি) অধীনে এই এনএসএসএস গঠন করে। এতে উঠে আসে, ৪৬ শতাংশ ভাতাভোগী যোগ্য না হয়েও ভাতা নিচ্ছেন।

চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে বলে সরকারের দাবি। এই টাকা ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

আগামী ২০২১–২২ অর্থবছরে সরকারি হিসাবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যদিও কর্মসূচিগুলোর হিসাবের মধ্যে অনেক গোঁজামিল রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের কাছে ধরা পড়েছে। তাঁদের মতে, অনেক কর্মসূচিই প্রকৃত বিচারে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নয়। এ খাতে বরাদ্দ দেওয়ার কাজটি করে অর্থ বিভাগ। তবে অর্থ বিভাগের সচিব আবদুর রউফ তালুকদার এ নিয়ে কথা বলতে চান না।

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়ছে। আর সে জন্য বাড়ানো হচ্ছে বরাদ্দও। যদিও আওতা বাড়ছে শুধু বয়স্ক ও বিধবাদের ক্ষেত্রে। এদিকে ভাতা বাড়ানো হচ্ছে শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

এনএসএসএসের প্রতিবেদনে উঠে আসে, সঠিক লোকের কাছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সহায়তা পৌঁছাতে পারলে বাড়তি ব্যয় ছাড়াই ২৬ লাখ পরিবারের ১ কোটি ৭ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে তুলে আনা সম্ভব। এনএসএসএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি অনিয়ম বা ভুল হয়েছে বয়স্ক ভাতার তালিকায়। বয়স্ক ভাতা পেতে পুরুষের বয়স ৬৫ ও নারীর ৬২ বছর বয়স থাকা বাধ্যতামূলক। এটি মানা হচ্ছে না ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশের ক্ষেত্রে। আবার বয়স্ক ভাতা পেতে মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার কম থাকতে হয়। বাস্তবে বেশি আয়ের লোকেরাও নিচ্ছেন এই ভাতা।

কোভিড মানুষকে নতুন করে গরিব বানিয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি দরকার। ত্রুটিপূর্ণ তালিকাগুলোর সংশোধনও দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর সমন্বয়ের ব্যবস্থা থাকা চাই।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫ শতাংশ নারী বিধবা বা স্বামী নিগৃহীতা না হয়েও ভাতা পাচ্ছেন। এই ভাতা পাওয়ার অন্যতম শর্ত মাসিক আয় ১২ হাজার টাকার কম থাকা। কিন্তু তালিকায় মাসিক ১২ হাজার টাকার বেশি আয় করা লোকের সংখ্যা প্রায় ১২ শতাংশ।

এ ছাড়া সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি পর্যন্ত চাল কেনার যে কর্মসূচিতেও রয়েছে সচ্ছলদের নাম। অন্য কর্মসূচিগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। আর সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ঢাকা বিভাগে। এর পর চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে। সবচেয়ে কম অনিয়ম সিলেট বিভাগে। উভয় তালিকাই তৈরি করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসন মিলে।

স্থায়ী কর্মসূচিগুলোর ত্রুটিপূর্ণ তালিকা সংশোধন না করেই আওতা বাড়ানো হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর দুটি কর্মসূচির আওতা। প্রথম দফার ১১২ উপজেলার পাশাপাশি দ্বিতীয় দফায় ১৫০ উপজেলায় দেওয়া হবে বয়স্ক ভাতা এবং স্বামী পরিত্যক্ত ও বিধবা ভাতা। এতে অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। ভাতার পরিমাণ অবশ্য ৫০০ টাকাই থাকছে। বয়স্ক ও বিধবা—এ দুটিতে চলতি অর্থবছরের ৬১ লাখ ভাতাভোগী থেকে নতুন করে বাড়ছে ২০ লাখ।

আগামী অর্থবছরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতাও বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে তাঁরা মাসে ১২ হাজার টাকা করে সম্মানী পান। এটা বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ত্রুটিপূর্ণ তালিকার কথা আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি। সমস্যাটা গোড়া থেকেই ছিল। রাতারাতি বদলে যাবে—এটা আশা করছি না। কিন্তু কাজটি শুরু করা দরকার।’

সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘কোভিড মানুষকে নতুন করে গরিব বানিয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি দরকার। ত্রুটিপূর্ণ তালিকাগুলোর সংশোধনও দরকার। আমার মতে, মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর সমন্বয়ের একটা ব্যবস্থা থাকা চাই।’