২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বরের পরে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয় কমিটির কোনো সভাই হয়নি।
দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের কোনো কৌশলই এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেনি সরকার। যদিও কৌশলের খসড়া হয়েছে দুই বছর আগে। এই কৌশল চূড়ান্ত করার দায়িত্ব অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয় কমিটির। অথচ কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর। এখনো সভা ডাকার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে পাচার করা অর্থ ফেরাতে নানা আলোচনা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অবশ্য কেউ যদি স্বেচ্ছায় ফেরত আনতে চান, সেটি ভিন্ন কথা।
অর্থ পাচার এখন দেশে বহুল আলোচিত বিষয়। ঘুষ-দুর্নীতির টাকা যেমন চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে, তেমনি ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া ও কানাডায় কথিত সেকেন্ড হোম এবং দুবাই ও সিঙ্গাপুরে হোটেলে বিনিয়োগ, বাড়ি ক্রয়ের পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকায় স্থায়ী হওয়াও এখন নিয়মিত ঘটনা। এ জন্য সরকারেরও মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। সে জন্য পাচার করা অর্থ দেশে ফেরাতে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে টাকা বৈধ করার সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
করোনার কারণে নিয়মিত সভা করা সম্ভব হয়নি। দ্রুতই সভা ডাকা হবে। এখন পাচারের অর্থ ফেরত আনায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থমন্ত্রী
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান। জানতে চাইলে এ নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে নিয়মিত সভা করা সম্ভব হয়নি। দ্রুতই সভা ডাকা হবে। এখন পাচারের অর্থ ফেরত আনায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অর্থ ফেরাতে যে উদ্যোগ নিয়েছি, তা নিয়ে আমি আশাবাদী। বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর যাচ্ছেন। সামনে এসবে গুরুত্ব আরও বাড়বে।’
এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর; অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক। সদস্যসচিব হচ্ছেন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান কর্মকর্তা।
এ-সংক্রান্ত সরকারি বিধিমালায় অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয় কমিটি, ওয়ার্কিং কমিটি ও প্রাথমিক যোগাযোগ কর্মকর্তার দায়দায়িত্ব বলা আছে। বিধিমালায় বলা হয়েছে, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয় কমিটি নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। এই কমিটি অর্থ পাচার প্রতিরোধে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য অন্যান্য দেশের নেওয়া উদ্যোগ পর্যালোচনা করে বিএফআইইউকে কৌশল নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিএফআইইউ ২০২০ সালের মাঝামাঝি সেই কৌশল প্রণয়ন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তবে এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।
কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, বাণিজ্যভিত্তিক পাচার ও হুন্ডির পাশাপাশি ইলেকট্রনিকস লেনদেন, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, শিক্ষা ও চিকিৎসার নামে অর্থ পাচারের সুযোগ রয়েছে। এসব অর্থ জমা হয় ব্যাংক হিসাবে, বিধিবদ্ধ জমায় (অভিবাসন স্কিমের আওতায়), বাসা-হোটেল জমিসহ স্থাবর সম্পত্তি কেনায়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক লেনদেন পরিচালনায়।
এতে আরও বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচির আওতায় ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৩১৫ জন বাংলাদেশি সুযোগ নিয়েছেন। এ প্রকল্পে অংশ নিতে ৫০-এর কম বয়সীদের ৫ লাখ রিঙ্গিত (১ কোটি ৫ লাখ টাকা) ও এর বেশি বয়সীদের সাড়ে ৩ লাখ রিঙ্গিত (৭৪ লাখ টাকা) নগদ অর্থ থাকতে হয়। যাঁরা মালয়েশিয়ায় চলে যান, তাঁরা প্রত্যেকে ২ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ সঙ্গে নিয়ে যান। এভাবেই দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
অন্য যেসব দেশে অর্থ পাচার হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং ও অস্ট্রেলিয়া।
এদিকে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুই দশকে সেই দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে গত বছর। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় ওই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।
পাচার করা অর্থ ফেরানোর কৌশল হিসেবে প্রাথমিক তথ্য ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন সংগ্রহ এবং সম্পত্তি চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে। তখন সম্পদ জব্দ করতে হবে। যে অপরাধ করেছে, তা অন্য দেশের সঙ্গে যৌথভাবে তদন্ত করতে হবে। এরপর বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সবশেষে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করে পাচার হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া। তবে এসব প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি। এ জন্য উচ্চ কর আরোপের মাধ্যমে এসব অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।