বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
এম সাইফুর রহমান তিন দফায় দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রথমবার অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৮০ সালে, জিয়াউর রহমান তখন প্রেসিডেন্ট। সেবার তিনি দুটি বাজেট দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফায় অর্থমন্ত্রী হন ১৯৯১ সালে। এরপর আবার অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০০১ সালে। সব মিলিয়ে তিনি ১২টি বাজেট দিয়েছিলেন। একই রেকর্ড আছে আবুল মাল আবদুল মুহিতের। তিনিও ১২ বার বাজেট পেশ করেছিলেন। তবে মানুষ প্রয়াত এম সাইফুর রহমানকে মনে রাখবে তাঁর নেওয়া নীতির জন্য। দেশের অর্থনীতিতে সংস্কার এসেছে তাঁরই হাত ধরে, যা সুফল দেশের অর্থনীতি বছরের পর বছর ধরে পাচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো দেশে সংস্কার করা খুব সহজ কাজ নয়। সংস্কারের প্রথম ধাক্কা সহ্য করার সক্ষমতাও অনেকের থাকে না। সংস্কারের সবচেয়ে বেশি বাধা আসে শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী মহল থেকে, যারা সংস্কার না হলেই লাভবান হন বেশি। আকবর আলি খান তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে লিখেছেন, ‘সংস্কার হলো একধরনের যুদ্ধ। সকল যুদ্ধেই রণনায়কদের মনে রাখতে হয় যে, শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনাই যথেষ্ট নয়, সব সময়েই পেছনে হটে যাওয়ার জন্য আপৎকালীন পরিকল্পনা থাকতে হবে। সংস্কারকে শুধু সাফল্যের জন্য প্রস্তুত থাকলেই চলবে না, ব্যর্থতার জন্যও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সংস্কার হলো প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের মতো জটিল। প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক যেকোনো আহাম্মকও শুরু করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের সম্পর্কের সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি টানতে পারে একমাত্র পাকা খেলোয়াড়েরাই। সংস্কারও যেকোনো আহাম্মক শুরু করতে পারে কিন্তু সবাই সংস্কার শেষ করতে পারে না। যারা সংস্কার করে তারা বাঘের পিঠে চড়ে বসে।’
এম সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালে যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তখন এরশাদের মাত্রই পতন হয়েছে। এরশাদ আমলের অর্থনীতিকে অনেকে বলে থাকেন অন্ধকারের দশক। যদিও শেষ দিকে এসে দাতাদের চাপে পড়ে সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে করব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের সংস্কার। দায়িত্ব নেওয়ার পরে সাইফুর রহমান অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার শুরু করেছিলেন। তবে মনে রাখা দরকার, তখন ভারতের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন মনমোহন সিং। এই অঞ্চলে সংস্কার এনেছিলেন মূলত তিনি। আবার বিশ্বজুড়েই তখন সংস্কারের হাওয়া লেগেছিল। বিশেষ করে বাণিজ্যব্যবস্থাকে উদার করার ক্ষেত্রে। এম সাইফুর রহমানও সেই পথে পা বাড়িয়েছিলেন। কেননা, তখন অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সংস্কারের কোনো বিকল্প ছিল না।
আবারও আকবর আলি খানের বই থেকে কয়েক লাইন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করাই যথেষ্ট নয়। সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। কিন্তু ভালো অর্থনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভালো রাজনীতি নয়। যে ধরনের সংস্কার ভোটারদের আকৃষ্ট করে না, সে ধরনের সংস্কার রাজনীতিবিদদেরও আশীর্বাদ লাভ করে না। রাজনীতিবিদদের পক্ষে সংস্কার সম্ভব নয়, সংস্কারের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের। রাজনীতিবিদদের চিন্তা আগামী নির্বাচনে সীমাবদ্ধ, একমাত্র বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়করাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে চিন্তা করতে অভ্যস্ত।’
এখন প্রশ্ন হলো, এম সাইফুর রহমান কী ধরনের সংস্কার হাতে নিয়েছিলেন। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ নিয়ে লিখেছেন, ‘আমাদের আলোকিত অর্থমন্ত্রীরা তাঁদের বাজেটীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত ও নীতি সংস্কারের পদক্ষেপ নিতেন। আমি ইতিহাস থেকে এ ধরনের দুটি পদক্ষেপের কথা স্মরণ করতে পারি, যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে। প্রথমটি হলো ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং দ্বিতীয়টি ২০০১ সালের পর মুদ্রার নমনীয় বিনিময় হার পদ্ধতি চালু করা। এ দুটি বড় সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে ভিন্ন দুই মেয়াদে। বাংলাদেশে ভ্যাট প্রবর্তন এবং বৈদেশিক মুদ্রার নমনীয় বিনিময় হার পদ্ধতি চালুর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির বিষয়ে আমরা অনেকেই সংশয়ে ছিলাম। বস্তুত অর্থমন্ত্রী নিজেই প্রস্তাবিত পদক্ষেপের ওপর উন্মুক্ত বিতর্কে আমাদের সঙ্গে অংশ নেন। সাইফুর রহমান শেষ পর্যন্ত এসব সংস্কার নিয়ে এগিয়ে যান। এখন পেছনে ফিরে দেখলে মনে হয়, তিনি সঠিক ছিলেন।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও লিখেছেন, ‘বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করতে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণে সাইফুর রহমানের অবদানের মধ্য থেকে ব্যাংকিং সংস্কার কমিটি গঠনের বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। বেসরকারি ব্যাংকের করপোরেট সুশাসনের উন্নয়ন এবং রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় জোরদারে ওই কমিটির সুপারিশ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিতাপের বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে পরিচালকসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মেয়াদের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে আগের অবস্থায় ফেরত নেওয়া হয়েছে।’
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান নিয়ে কথা বলতে হলে আরেকটি ঘটনার কথা অবশ্যই বলতে হবে। যেকোনো নতুন সরকার এলেই নতুন ব্যাংক দেওয়া শুরু হয়। দলীয় লোকজনকে ব্যাংক দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতি নয়, বরং রাজনৈতিক বিবেচনাতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে নতুন ব্যাংক নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তখন সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিল, দেশের অর্থনীতিতে আর নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। যেসব ব্যাংক আছে, সেগুলোকেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানের নীতিমালায় এনে পরিচালিত করা কঠিন চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এম সাইফুর রহমান বেসরকারি খাতে আর কোনো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাজনৈতিক চাপ থাকলেও তা তিনি প্রতিহত করেছিলেন। বিএনপি সরকারের ওই পাঁচ বছরে নতুন ব্যাংকের আর লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষার কর্মসূচিও তাঁর সময়ে শুরু হয়েছিল।
এম সাইফুর রহমানের আরেকটি বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন, দলের ওপর তাঁর প্রভাব ছিল, ফলে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাও তিনি পেয়েছিলেন। দেশের অন্য কোনো অর্থমন্ত্রী এই স্বাধীনতা পাননি।
এম সাইফুর রহমানের জন্ম ১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে। তিনি ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি লন্ডনে পড়াশোনা করেন (১৯৫৩-১৯৫৮) এবং ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস) থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
এম সাইফুর রহমান শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর কর্মস্থল ছিল পাকিস্তানের করাচিতে। তবে সে কাজ ছেড়ে তিনি ঢাকায় চলে এসেছিলেন। ১৯৬২ সালে দুই সহকর্মীকে নিয়ে রহমান রহমান হক অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি নিরীক্ষা ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি এখন সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করে।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সাইফুর রহমান ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাইফুর রহমান ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে বেসরকারি খাত হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন। তিনি ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য ছিলেন।
সাইফুর রহমান ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন। এ দলটিই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) রূপান্তরিত হয়। তিনি ১৯৭৯ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার সদর এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রী এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে এবং পুনরায় ২০০১ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়।