অর্থনীতির যে ৫ সূচক নিয়ে দুশ্চিন্তা

বিশ্বজুড়েই কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন উত্তরণের পথে। এই উত্তরণ পুরো বিশ্বে সমভাবে হবে, নাকি অসম প্রবৃদ্ধি ঘটবে, এ নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতি উত্তরণের পথে থাকলেও প্রবৃদ্ধি সমভাবে হবে না। বিশ্বব্যাপী সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আবার ফিরে আসছে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’। এটি এমন এক অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে কোনো অর্থনীতি একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ বেকারত্বের চক্রে আটকা পড়ে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি আশাবাদ দেখালেও অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে।

স্প্যানিশ ফ্লু–তে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল

স্প্যানিশ ফ্লু ও সে সময়ের বিশ্ব

বিশ্বজুড়ে এর আগের মহামারিটি ছিল ১০০ বছর আগের। স্প্যানিশ ফ্লু দেখা দিয়েছিল ১৯১৮ সালে, যা অব্যাহত ছিল দুই বছরের কিছু বেশি সময়। তখন এর চিকিৎসা ছিল না, এমনকি কোনো টিকারও আবিষ্কৃত হয়নি। স্প্যানিশ ফ্লুর ছিল তিনটি ঢেউ বা ধাক্কা। প্রথমটি আসে ১৯১৮ সালে। তবে একই বছরের সেপ্টেম্বরে আসা দ্বিতীয় ঢেউটি ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী। এর স্থায়িত্ব ছিল পরের বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত। আর তৃতীয় বা শেষ ঢেউটি এসেছিল ১৯১৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসে, যা চলে বছরের শেষ সময় পর্যন্ত।

স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রায় ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যা বিশ্বের সে সময়ের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১ শতাংশ। দেশগুলোর মধ্যে কেনিয়ার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ভারতের ৫ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল মহামারিতে। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যুহার ছিল কম, দশমিক ৫ শতাংশ এবং স্পেনে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। স্প্যানিশ ফ্লুর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছিল ৬ শতাংশ, আর ভোগ কমে যায় ৮ শতাংশ। সে সময়ে মূল্যস্ফীতিও অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

তবে এখনকার বিশ্ব যতটা শান্ত, স্প্যানিশ ফ্লু-পরবর্তী বিশ্ব ততটা ছিল না। স্প্যানিশ ফ্লু যখন প্রথম দেখা দেয়, তখনো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়নি। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছিল বড় ধরনের মন্দা। বেকারত্বের হার ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। মন্দা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে দেখা দিয়েছিল নানা অস্থিরতা ও সংঘাত। ঘটে শ্রমিক বিদ্রোহ।

‘পালমার রেইডস’ নিয়ে সংবাদপত্রের রিপোর্ট

এর মধ্যেই শুরু করা হয়েছিল ‘পালমার রেইডস’। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের উদ্যোগে দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল এ মিচেল পালমারের নামে করা এই ধরপাকড়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে আটক করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। মূলত বামপন্থী কমিউনিস্ট এবং ইতালি ও পূর্ব ইউরোপের অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এ অভিযান চলেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল।
স্প্যানিশ ফ্লু-পরবর্তী অর্থনীতি মূলত ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছিল ১৯২৩ সালে। ঘুরে দাঁড়ানোর কৃতিত্ব দেওয়া হয় সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন জি হার্ডিংকে।

১৯২০ সালে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ওহাইওর এক সংবাদপত্রের মালিক ওয়ারেন হার্ডিং। অর্থনীতিতে চাঙা করতে তিনি নানা ধরনের কর ছাড়, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নতুন বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন। অর্থনীতির এই চাঙা ভাব থাকে ১৯২৯ সালের বিশ্বমন্দার আগপর্যন্ত।

প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন জি হার্ডিং তুমুল জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় মাত্র ৫৭ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পরে অবশ্য জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছিল। পরে জানা যায়, তিনি একাধিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। এমনকি নান্না পপহাম ব্রিটন নামের এক নারী দাবিও করেছিলেন যে তাঁর মেয়ে এলিজাবেথের বাবা আসলে প্রেসিডেন্ট হার্ডিং। তখন সব পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হলেও ২০১৫ সালে এসে ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষেই এলিজাবেথের পিতা হার্ডিং। প্রেসিডেন্ট হার্ডিংয়ের আরেকটি কেলেঙ্কারির নাম ‘দ্য টিপট ডোম স্ক্যান্ডাল’। মূলত ঘুষ খেয়ে বিনা দরপত্রে টিপট ডোম নামের এক কোম্পানিকে কাজ দেওয়া থেকেই এই কেলেঙ্কারির জন্ম। নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির আগে টিপট ডোম কেলেঙ্কারিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কুখ্যাত রাষ্ট্রীয় ‘স্ক্যান্ডাল’।

এখনকার বিশ্ব

কোভিড-১৯ সময়ের এখনকার বিশ্বের সবচেয়ে প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বে কি স্ট্যাগফ্লেশন আবার ফিরে আসছে। স্ট্যাগফ্লেশন হচ্ছে একই সঙ্গে স্থবিরতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি। আর এর অর্থ হচ্ছে নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ বেকারত্ব। এ সময় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে অর্থনীতির জন্য একে খুব খারাপ সময় ধরা হয়। কেননা, এ সময় মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণত তহবিলের সুদহার বাড়িয়ে দেয়। এতে ব্যাংকঋণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। ঋণ নেওয়ার ব্যয় বাড়লে বিনিয়োগও ব্যয়বহুল হয়। এতে বিনিয়োগ কমে যায়, আর বিনিয়োগ কমলে নতুন কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয়।

মার্কিন অর্থনীতিতে এ রকম অবস্থা দেখা দিয়েছিল ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে এসে। ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ, আর ১৯৮২ সালে এসে বেকারত্ব বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।

করোনার সংক্রমণ কমে যাওয়ায় একদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। এতে বিশ্ববাজারে তেল, কয়লাসহ সব ধরনের জ্বালানির দর বেড়ে গেছে। আবার একই সঙ্গে সরবরাহব্যবস্থা এখনো আগের অবস্থায় ফেরেনি। পণ্য পরিবহনের জাহাজভাড়াও ঊর্ধ্বমুখী। এসবের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী এখন মূল্যস্ফীতি দেখা দিচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের এক পক্ষ মনে করছে, বিশ্বে আবারও ফিরে আসছে স্ট্যাগফ্লেশন। এ অবস্থার উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভূমিকাই প্রধান। কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকই মুদ্রানীতি তৈরি করে। আর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ উন্নত দেশগুলোর মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ ও বেকারত্বের হার কমিয়ে আনা।

বাংলাদেশ: পাঁচ সূচক নিয়ে দুশ্চিন্তা

বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো করলেও সব সূচকই স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। রপ্তানি বেড়েছে, কাঁচামাল ও পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে, বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণও বাড়ছে। এর বিপরীতে অন্তত পাঁচটি সূচক নিয়ে সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন।

১. মুদ্রাস্ফীতি: কাগজে-কলমে এখনো দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে, ৬ শতাংশের নিচে। তবে বাজারদরের প্রতিফলন সরকারি পরিসংখ্যানে নেই। প্রায় সব ধরনের পণ্যের দরই ঊর্ধ্বমুখী। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্তের এখন সংসার চালানোই দায়। সারা বিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে ব্যস্ত। আর এখন এই মূল্যস্ফীতি স্ট্যাগফ্লেশনের দিকে নিয়ে যায় কি না, সেটাই এখন আলোচনা ও পরিকল্পনার বিষয়।

২. প্রবাসী আয়: করোনার প্রবল সংক্রমণের সময়েও প্রবাসী আয় ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু চার মাস ধরেই প্রবাসী আয় টানা কমেছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে দশমিক ১৯ শতাংশ। চলাচলব্যবস্থা কার্যত বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সঙ্গে ছিল ২ শতাংশ প্রণোদনা। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা চালু হওয়ার পর আয় কমতে শুরু করেছে। নতুন দুশ্চিন্তার নাম প্রবাসী আয়ের নিম্নগতি।

৩. নতুন দারিদ্র্য: করোনার ঠিক আগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। অতিমারিতে কত মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, এর কোনো সরকারি হিসাব নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের জরিপ বলছে, দেশে এখন ৪২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। তবে সরকারের নীতিনির্ধারণ এবং পরিকল্পনার জন্য অবশ্যই এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা জানাটা জরুরি বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

৪. বৈষম্য: একটা সময় বলা হচ্ছিল করোনা-পরবর্তী বিশ্বে উত্তরণ কবে ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের। অর্থাৎ অর্থনীতি নিম্নমুখী হয়ে তা দীর্ঘ সময় বজায় থাকবে। পরে বলা হলো উত্তরণ হবে ইংরেজি ‘ভি ‘অক্ষরের মতো। অর্থাৎ অর্থনীতি দ্রুত নেমে গেলেও আবার দ্রুত ওপরে উঠে যাবে। আর এখন বলা হচ্ছে, উত্তরণ ঘটবে ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো। এর অর্থ হলো, এক দলের উত্তরণ হবে ঊর্ধ্বমুখী, অন্য দল চলে যাবে নিচে। অর্থাৎ মূলত দেশে দেশে প্রকট হবে আয় ও সম্পদে বৈষম্য।
দেশে এমনিতেই বৈষম্য বাড়ছিল। করোনা তা আরও প্রকট করছে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

৫. খেলাপি ঋণ: সরকার করোনা মোকাবিলায় এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা তহবিলের জোগান দিয়েছে। এর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে শিল্প খাতে। এই অর্থের কত অংশ উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই এ প্রশ্ন তুলেছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ গণনা দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। সুতরাং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কী পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে ফিরে আসবে, সে প্রশ্ন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের।

সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিলে কষ্টে পড়বে সীমিত আয়ের মানুষ। আর এরই মধ্যে যাঁরা গরিব হয়ে গেছেন, তাঁরা থাকবেন সবচেয়ে বিপাকে।