অমিক্রনে কমেছে বিক্রি, বেড়েছে ব্যয়

গত বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় এ বছরের জানুয়ারি মাসে ১২ শতাংশ বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মনে করছে, পুনরুদ্ধারের প্রকৃতি দুর্বল।

এক জরিপে ৭১ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলেছে, অমিক্রন সংক্রমণের প্রভাবে তাদের রপ্তানি বা বিক্রি কমেছে। ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বলেছে, এ জন্য তাদের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে এবং তাতে খরচ বাড়ছে। ৮২ শতাংশ বলেছে, অমিক্রনের প্রভাবে সার্বিকভাবে পুঁজি ও শ্রমের খরচ বেড়েছে। রপ্তানি কমার ঝুঁকি বেড়েছে বলে জানিয়েছে ৮৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান।

দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস কমেছে। মূলত করোনাভাইরাসের অমিক্রন ধরনের বাড়বাড়ন্তের কারণে তাদের আত্মবিশ্বাসে কিছুটা ভাটা পড়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান উপস্থাপনা দেন।

চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ১৭ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বলেছে, দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শক্তিশালী হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার মাঝারি মানের হচ্ছে বলে জানিয়েছে ৪৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এবং দুর্বল হচ্ছে বলেছে ৩৯ শতাংশ।

এর আগে অক্টোবর মাসে পরিচালিত একই জরিপে দেখা গেছে, পুনরুদ্ধার শক্তিশালী হচ্ছে মনে করত ২১ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং দুর্বল হচ্ছে মনে করত ২৭ শতাংশ আর মধ্যম মানের হচ্ছে মনে করত ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ, অক্টোবর মাসের তুলনায় এখন ১২ শতাংশ বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মনে করছে, পুনরুদ্ধারের প্রকৃতি দুর্বল।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত অতটা সংগঠিত নয় বলে সুযোগ-সুবিধা আদায়ে পিছিয়ে থাকে—এটাই রাজনৈতিক-অর্থনীতি।
সেলিম রায়হান নির্বাহী পরিচালক, সানেম

জরিপে জানা গেছে, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং করোনার নতুন ধাক্কা সত্ত্বেও ব্যবসা পুনরুদ্ধারের হার গড়ে ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ২০২১ সালের জুন মাসের পর যে হারে পুনরুদ্ধার হচ্ছিল, এখন তার গতি কিছুটা কম।

মহামারি শুরু হওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যের আত্মবিশ্বাস নিয়ে মোট সাতটি জরিপ পরিচালনা করেছে সানেম। দেখা গেছে, যখন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা একটু বেশি থাকে এবং নানা রকম বিধিনিষেধ থাকে, তখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। আবার যখন আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণে (৫ শতাংশের নিচে) চলে আসে, তখন আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বর্তমানে করোনাভাইরাসের অমিক্রন ধরনের বাড়বাড়ন্তের কারণে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস কিছুটা নিচের দিকে।

জরিপের একটি বড় অংশ ছিল কোভিড মোকাবিলায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকারিতা নিয়ে। বলা হয়েছে, জরিপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশ প্রণোদনা পায়নি—পেয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ। প্রণোদনা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পুনরুদ্ধারের হার ৭১ শতাংশ, আর প্রণোদনা না পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনরুদ্ধারের হার ৫৮ শতাংশ।

অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা পেয়েছে, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ জানিয়েছে, এই প্যাকেজ তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে আরও সাহায্য দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের সহায়তা দরকার—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, স্বল্প সুদে কার্যকরী পুঁজির ঋণ, রপ্তানিকারকদের জন্য শিপমেন্ট-পূর্ববর্তী পুনঃ অর্থায়ন সুবিধা ও শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি।

পিছিয়ে আছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত

জরিপে দেখা গেছে, ৯ শতাংশের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা ঋণ পেয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সেলিম রায়হান বলেন, বড় ও সংগঠিত খাতের সংগঠন শক্তিশালী। তারা সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারে। সে জন্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে থাকে। সংগঠিত হওয়া নিশ্চয়ই খারাপ কিছু নয়, তবে অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করা সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত অতটা সংগঠিত নয় বলে সুযোগ-সুবিধা আদায়ে পিছিয়ে থাকে—এটাই রাজনৈতিক-অর্থনীতি।

কোভিডের শুরুতেই সরকার বড় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। তার আকারও নিতান্ত তুচ্ছ নয়—জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের জন্যও পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু সেটা বিতরণ করা যাচ্ছে না। ব্যাংক যে কাগজপত্র চায়, সেটা তারা অনেক ক্ষেত্রেই দিতে পারে না। সেখানে কিন্তু বড় বা সংগঠিত খাতের সংগঠনগুলো বাগড়া দিতে আসেনি।

সেলিম রায়হান মনে করেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ থাকা দরকার হলেও সে রকম কিছু দেখা যায়নি। তবে উন্নত দেশগুলোর ক্ষুদ্র-মাঝারি ও অসংগঠিত খাত সরকারের অনেক সমর্থন পেয়েছে।

জরিপের ধরন

দেশের আটটি বিভাগের ৩৮টি জেলার মোট ৫০২টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। কোভিড শুরুর পর থেকে ব্যবসায়িক আত্মবিশ্বাস নিয়ে সানেম মোট সাতটি জরিপ করেছে। উৎপাদন খাতের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ প্রস্তুতকারক, হালকা প্রকৌশল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। সেবা খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, পরিবহন, আইসিটি, টেলিযোগাযোগ, আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট খাত জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ৩ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে এই জরিপ করা হয়েছে।