চাষিরা আখ চাষ ছেড়ে লাভজনক অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। দাম বেশি পাওয়ায় গুড় প্রস্তুতকারকদের কাছে আখ বিক্রি করে দিচ্ছেন।
পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার আখচাষি মো. সাজ্জাদ সেলিম আগে ১৬ একর জমিতে আখ চাষ করতেন। কিন্তু গত মৌসুমে তিনি আখ চাষ করেছেন ১০ একরে। বাকি জমিতে ভুট্টাসহ অন্য কয়েকটি ফসল বুনেছেন। একই অবস্থা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আখচাষি শেখ সালেকুল হকের। তিনি আগে চার একর জমিতে আখ চাষ করতেন। এখন করছেন মাত্র দুই একরে।
মুঠোফোনে আখচাষি সাজ্জাদ সেলিম ও সালেকুল হকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে জানা যায়, একসময় তাঁদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল আখ। কিন্তু এখন আখের দাম অনেক কম। তাই তাঁরা বিকল্প ফসলের আবাদ করছেন। একইভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকার আখচাষিরা বছর বছর আখ চাষ কমিয়ে দিচ্ছেন।
সালেকুল হক বলেন, ‘সরকারি চিনিকলগুলো আখের যে দাম দিচ্ছে, তাতে আমাদের এখন আর পোষাচ্ছে না। এ ছাড়া আমাদের যে বীজ দেওয়া হয়, তা নিম্নমানের। সব মিলিয়ে চাষিরা প্রতিবছর আখ চাষ কমিয়ে দিচ্ছেন।’
সরকারি সুগার মিল বা চিনিকলগুলোতে উৎপাদিত চিনির দাম গত এক দশকে প্রায় দেড় শ গুণ বেড়েছে। সে তুলনায় আখের দাম বাড়েনি বলে অভিযোগ চাষিদের। সে জন্য তাঁরা আখ চাষ ছেড়ে অন্যান্য বিকল্প ফসলে ঝুঁকছেন। বাজারে অবশ্য বেসরকারিভাবে আমদানি করা চিনির দাম আরও বেশি।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার (বিএসএফআইসি) কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন যে বর্তমানে সরকারিভাবে দেওয়া আখের দাম নিয়ে চাষিরা সন্তুষ্ট নন। ফলে অনেকেই আখের আবাদ কমিয়ে লাভজনক অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। আর যাঁরা এখনো আখ চাষে আছেন, তাঁদের একটি অংশ আবার গুড় প্রস্তুতকারকদের কাছে বেশি দামে আখ বিক্রি করছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রবণতা চলছে।
আখের সংগ্রহ বাড়াতে বিএসএফআইসি সর্বশেষ ২০২২–২৩ মাড়াই মৌসুমে আখের প্রতি মণ দাম ৪০ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকায় নির্ধারণ করেছে (প্রতি কুইন্টাল ৪৫০ টাকা, ১০০ কেজি = ১ কুইন্টাল)। কিন্তু তাতেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আখ সংগ্রহ করতে পারেনি বিএসএফআইসি পরিচালিত সরকারি চিনিকলগুলো।
কৃষকেরা চিনিকলগুলো থেকে আখের জন্য যে দাম পান, তা বর্তমান বাজার পরিস্থিতির তুলনায় উপযুক্ত না। এটা বিবেচনায় নিয়ে আমরা দাম বাড়ানোর বিষয়ে ইতিমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিমো. আরিফুর রহমান, চেয়ারম্যান, বিএসএফআইসি
চাষিরা বলছেন, আখের উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রতি মণ দাম ৩০০–৩৫০ টাকা (প্রতি কুইন্টাল ৭৫০–৮৭৫ টাকা) করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে উন্নত মানের বীজ সরবরাহের দাবি জানান তাঁরা। বিএসএফআইসিও মনে করে, আখের দাম আরও বাড়ানো উচিত।
জানতে চাইলে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘কৃষকেরা চিনিকলগুলো থেকে আখের জন্য যে দাম পান, তা বর্তমান বাজার পরিস্থিতির তুলনায় উপযুক্ত না। এটা বিবেচনায় নিয়ে আমরা দাম বাড়ানোর বিষয়ে ইতিমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি।’
বিএসএফআইসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, সংস্থাটি ২০১৩–১৪ মৌসুমে ৩৬ থেকে ৪০ টাকা দরে (মিলগেটে) চিনি বিক্রি করে। এখন মিলগেটে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। অর্থাৎ এক দশকে সংস্থাটি চিনির দাম বাড়িয়েছে দেড় শ শতাংশ। অবশ্য বাজারে খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম আরও বেশি।
বিএসএফআইসির চিনিকলগুলোর আওতাধীন কৃষকেরা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রায় ৩২ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদন করেছিলেন, যা সর্বশেষ ২০২২–২৩ মৌসুমে কমে মাত্র ৮ লাখ ৭ হাজার টনে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এক দশকে আখ উৎপাদন কমেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ।
বিএসএফআইসির ইক্ষু উন্নয়ন ও গবেষণা বিভাগের পরিচালক পুলক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘আমাদের ছয়টা মিল সাময়িক বন্ধ রয়েছে। এসব মিল সংশ্লিষ্ট এলাকার চাষিরা বর্তমানে আখের পরিবর্তে অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। চালু মিল এলাকাতেও অনেক চাষি আখের পরিবর্তে অন্য লাভজনক ফসল চাষ করছেন।’
সরকারি চিনিকলগুলোতে আখের সরবরাহ কমায় আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন কম হচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৫টি সরকারি মিলে চিনি উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার টন। এক দশক পর, অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালে সরকারি মিলগুলোতে চিনি উৎপাদন নেমে আসে মাত্র ২১ হাজার ৩১৩ টনে।
বিএসএফআইসির প্রধান রসায়নবিদ আহমাদ মসীহুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভালো মানের আখ গুড় বিক্রেতাদের কাছে চলে যাচ্ছে। চিনিকলে আসে নিম্ন মানের আখ। ফলে চিনি উৎপাদন কম হচ্ছে।
আখচাষিরা বলছেন, মিলগুলো আখের জন্য যে দাম দেয়, তা অনেক কম। এর বিপরীতে গুড় প্রস্তুতকারকেরা বেশি দাম দিয়ে আখ কিনে নেন। নাটোরের লালপুরের আখচাষি ইব্রাহীম খলিল মুঠোফোনে বলেন, সর্বশেষ মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকা দরেও আখ কিনেছেন গুড় প্রস্তুতকারকেরা। তাই মিলগেটে আখের দাম প্রতি মণ ৩০০–৩৫০ টাকা করা প্রয়োজন। তাহলে চাষিরা মিলমুখী হবেন।
মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, এ বিষয়ে তাঁরা এখন কাজ করছেন। তিনি বলেন, শুধু আখের দাম বাড়ালেই হবে না। আমরা কৃষকদের সাথি ফসলসহ আখ চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। তাতে কৃষকেরা আখ চাষের মাধ্যমে লাভবান হতে পারবেন। পাশাপাশি কৃষকদের উন্নত জাতের বীজও সরবরাহ করতে হবে। এ জন্য উচ্চফলনশীল জাতের নতুন আখ উদ্ভাবন করতে হবে। এটি আবার আমাদের সংস্থার আওতাধীন কাজ না। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এ কাজ করতে পারে।’