পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ইতিমধ্যে মূল সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়েছে। রেলসেতুর ওপর দিয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন গেছে। কিন্তু প্রকল্পটি যেন শেষ হইয়াও হইল না শেষ।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর খরচ ও মেয়াদ—দুই–ই বাড়ছে। এর মধ্যে খরচ বাড়ছে ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। আর মেয়াদ বাড়ছে আরও এক বছর। এখন প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হবে। মূলত মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে পরামর্শক সেবার মাশুলের পরিমাণও বেড়েছে। আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারের কিছু খরচ বেড়েছে।
এসব কারণে প্রকল্প সংশোধন করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সংশোধিত প্রস্তাব উঠছে।
২০০৭ সালে নেওয়া প্রকল্পটি এই পর্যন্ত দুইবার সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া একবার বিশেষ সংশোধন করা হয়েছিল। এখন তৃতীয় সংশোধনের প্রস্তাব যাচ্ছে একনেকে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (ভৌত অবকাঠামো বিভাগ) মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠিকাদারের বিলে কিছু খরচ বাড়তে পারে। প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না, ঠিকাদারের কত টাকা বাড়বে। তাই এখনই বাড়তি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যেন তখন আবার টাকা চাইতে না হয়। শেষ পর্যন্ত হয়তো পুরো টাকা খরচ হবে না।’
তিনি আরও বলেন, মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে পরামর্শক সেবা, ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে ভ্যাটে টাকা বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন, নদীশাসনের কারণে খরচ বেড়েছে।
প্রকল্পের প্রস্তাব অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি খরচ বাড়ছে পরামর্শক খাতে। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে পরামর্শক সেবার খরচও বেড়েছে। এ খাতে বাড়তি খরচ হচ্ছে ৯৫৭ কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণ করতে অতিরিক্ত ৪৩ মাস পরামর্শক সেবা লেগেছে। আর নদীশাসনে লেগেছে অতিরিক্ত ৫৫ মাস।
সরকার বৈদেশিক ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে ভ্যাট ও আয়কর হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছে। এর কারণে খরচ বাড়ছে ৪০৫ কোটি টাকা। নদীশাসনের জন্য আরও ২৮২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া কিছু অ্যাপ্রোচ সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট, রেলসেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ বেড়েছে।
এর বাইরে ২০১৫, ২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে বন্যা ও নদীর স্রোতের ফলে নদীতীরে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়। তখন নদীশাসন কাজে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছে। এ ছাড়া কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটকে বাংলাবাজারে স্থানান্তর করার সময়ও সেখানে নদীশাসন করতে হয়। ২০১২ সালে বর্ষার মৌসুমে মাওয়া এলাকার পুরোনো ফেরিঘাট পুরোপুরি নদীগর্ভে বিলীন হয়। তখন নদীশাসনের নকশায় পরিবর্তন আনতে হয়। এতেও খরচ বাড়ে।
সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যখন ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করা হয়, তখন প্রতি ডলারের দাম ধরা হয় ৭৮ টাকা ৩০ পয়সা। এরপর ডলারের দাম ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, ১০৭ টাকায় পর্যন্ত ডলার কিনতে হয়েছে। এ জন্য প্রকল্পের খরচ বেড়েছে।
এ ছাড়া সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের যাবতীয় খরচ এবং সব জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুষ্ঠানের খরচ মূল প্রকল্পের খরচে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এখন সেই খরচ সংশোধিত প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর জন্য ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সেতুর নকশা পরিবর্তন করে রেল অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন খরচ ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। মেয়াদ ধরা হয় ২০১৮ সাল। পরে আরও দুইবার খরচ বাড়িয়ে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা করা হয়।
খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ে। আগামী একনেক সভায় সংশোধিত প্রস্তাবের বাড়তি খরচ অনুমোদন হলে পদ্মা সেতুর মোট খরচ দাঁড়াবে ৩২ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। পুরো টাকা দেশজ উৎস থেকে দেওয়া হচ্ছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রথমে বিশ্বব্যাংকের অর্থ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্নীতি হতে পারে এমন অভিযোগ এনে ২০১২ সালে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। এ নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়েছিল।