২০১৯ সালের ২৬ মার্চ যাত্রা শুরু করে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ। প্রতিষ্ঠানটি চার বছর পূর্ণ করে পাঁচ বছরে পদার্পণ করেছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি এমএফএসের মাধ্যমে প্রবাসী আয় দেশে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে নগদের মালিকানা, এটির বৈধতা নিয়ে রয়েছে অনেকের মনে প্রশ্ন। আবার নগদ বাজারে আসায় বেড়েছে প্রতিযোগিতা, কমেছে লেনদেনের খরচ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন।
এমএফএস প্রতিষ্ঠান হিসেবে নগদ চার বছর পূর্ণ করেছে। চার বছর আগে যখন শুরু করেছিলেন, তখন লক্ষ্য কী ছিল। সেই লক্ষ্য গত চার বছরে কতটা পূরণ করতে পেরেছেন।
তানভীর আহমেদ: চার বছর আগে যখন শুরু করেছিলাম, তখন অনেকে আমাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। কারণ, আমাদের আগে ৩০টি ব্যাংক এ ব্যবসার চেষ্টা করে বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের পরিচালনা পর্ষদও তাই এ ব্যবসার বিরোধিতা করেছিল। সবার বিরোধিতা দেখে আমি নিজে বাজার জরিপ করি। তখন দেখি মানুষের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তখন মনে হলো, বাজারে চাহিদা থাকলে কেন একটি ব্যবসা সফল হবে না। তাই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। জরিপ করতে গিয়ে এ ব্যবসার প্রধান চ্যালেঞ্জ যেটি আবিষ্কার করলাম তা হলো, হিসাব খোলার ক্ষেত্রে ফরম পূরণ নিয়ে মানুষের মধ্যে একধরনের অনীহা রয়েছে। এ কারণে আমরা বাজারে আসার আগেই ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি বা ই-কেওয়াইসি ব্যবস্থা চালু করেছিলাম। আমরাই প্রথম এ দেশে এটি চালু করি। দু-তিন মাস না যেতেই দেখলাম তাতে ব্যাপক সাড়া। অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্রাহকও পেয়ে গেলাম। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে দেখলাম, গ্রাহক প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে। তখন আবার জরিপ চালালাম। জরিপে দেখলাম, মানুষের একটি বড় অংশই ফিচার ফোন ব্যবহারকারী। তখন আমরা মোবাইল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মিলে মোবাইলে *১৬৭# নম্বর চেপে হিসাব খোলার ব্যবস্থা চালু করি। এই ব্যবস্থা চালুর পর নগদকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র চার বছরে গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ২৫ লাখে। ডিজিটাল কেওয়াইসি ও ফিচার ফোনে হিসাব খোলার সুবিধা নগদকে এগিয়ে দিয়েছে। এরপর করোনাকালে মানুষকে নগদ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ আমাদের আরও এক ধাপ এগিয়ে দেয়। করোনাকালে আমাদের সফলতা দেখে সরকারের ১৭টি মন্ত্রণালয় তাদের ভাতা বিতরণে নগদকে বেছে নিয়েছে। বর্তমানে সরকারি ভাতার ৮০ শতাংশের বেশি নগদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।
এ কারণেই কি অনেকে অভিযোগ করেন, নগদ সরকারি নানা সেবার সুবিধা নিয়ে ব্যবসা করছে?
তানভীর আহমেদ: অনেকে হয়তো না জেনে, না বুঝে এ অভিযোগ করেন। আমরা বাজারে আসার আগেও তো সরকারি এসব সুবিধা ছিল। অন্যরা কেন তখন সেই সুবিধা কাজে লাগায়নি। সরকারি ভাতা বিতরণের সুবিধা নিতে আমরা নিজেরা যতটা না চেষ্টা করেছি, তার চেয়ে বেশি মন্ত্রণালয়গুলো নিজেরাই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। কারণ, তারা জানে কম খরচে আমরা এ সেবা দিই। এক মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে শুনে বা জেনে অন্য মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে এসেছে এ সেবা নিতে। আরও শুরু থেকে আমাদের লক্ষ্যই ছিল সাধারণ মানুষকে এ সেবার আওতায় আনা। তাই সরকারি ভাতা বিতরণের প্রস্তাব যখনই আমরা পেয়েছি, তখনই তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া আমাদের সঙ্গে যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাই মন্ত্রণালয়গুলো আমাদের ওপর বেশি আস্থা রেখেছে।
শুরু থেকে আপনারা কম খরচে লেনদেন সুবিধা দিচ্ছেন। নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ ধরনের উদ্যোগ কতটা ব্যবসাসফল হয়েছে?
তানভীর আহমেদ: গ্রাহকদের যত ধরনের সুবিধাই আমরা দিয়েছি, সেটা কোনোভাবেই ব্যবসায়িকভাবে লোকসান করে দিইনি। আবার এ কোম্পানি গঠনের পেছনে আমরা হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগও করিনি। গ্রাহকদের কম খরচে লেনদেনের সুবিধা দেওয়ার পরও আমি সেখান থেকে লাভ করেছি। হয়তো বাজারের প্রতিযোগীদের তুলনায় কম লাভ করেছি। কিন্তু শুরু থেকে লোকসান করে আমরা কোনো ব্যবসা করিনি। গত তিন বছরে নগদ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হয়েছে। বিশ্বে খুব কমসংখ্যক কোম্পানি আছে, যারা এত কম সময়ে এ ধরনের সফলতা পেয়েছে। লোকসানে ব্যবসা করলে তো সেটা হতো না।
এখনো আপনাদের নিয়ে অনেকের অভিযোগ বিনা লাইসেন্সে চলছে নগদের কার্যক্রম। এত দিন ব্যবসা করার পরও কেন এ অভিযোগ?
তানভীর আহমেদ: একটি গোষ্ঠী আমাদের নিয়ে এ গুজব বাজারে ছেড়েছে। আর পুরোটা না জেনে অনেকে হয়তো তা বিশ্বাসও করছে। আপনারা যদি দেখেন তাহলে দেখবেন দেশের যেকোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আগে এনওসি বা অনাপত্তিপত্র দিয়ে তাদের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করে। একটি ধাপে এসে চূড়ান্ত সনদ পায়। দেশে প্রথম যে এমএফএস প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করেছিল, তারা কিন্তু পাঁচ বছর অনাপত্তিপত্র দিয়ে চলেছে। শুরু থেকে ডাক বিভাগ ছিল আমাদের আয় ভাগাভাগির অংশীদার। ২০১৮ সালে এমএফএসের যে গাইডলাইন ছিল, সেখানে বলা ছিল কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশীদার না হয়ে কেউ এ ধরনের ব্যবসা করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের অংশীদারত্বে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। এ কারণে আমাদের অনাপত্তিপত্রের মেয়াদ বারবার বাড়াতে হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা নগদ ফাইন্যান্স নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন পেয়েছি। এখন নগদ ফাইন্যান্সই নগদ লিমিটেডের ৫১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করবে। আশা করছি, কয়েক মাসের মধ্যেই লাইসেন্সের বিষয়টির সুরাহা হয়ে যাবে। তবে ডাক বিভাগ যথারীতি আমাদের সঙ্গে আয় ভাগাভাগির অংশীদার হিসেবে থাকবে। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করছি, ডাক বিভাগ কিন্তু নগদের মালিকানার অংশীদার নয়। সংস্থাটি রাজস্ব ভাগাভাগির অংশীদার।
নগদ ফাইন্যান্সের অধীনে মালিকানা যাওয়ার পর নগদের সেবায় কোনো পরিবর্তন আসবে কি?
তানভীর আহমেদ: আমাদের পরিকল্পনা আগামী অক্টোবরে নগদকে নতুন রূপে মানুষের সামনে নিয়ে আসার। পাশাপাশি নতুন নতুন সেবা যুক্ত করে একটি সুপার অ্যাপ চালু করব। যে অ্যাপের মাধ্যমে একজন গ্রাহক সব ধরনের আর্থিক সেবা পাবেন। তাতে নতুনত্ব আসবে নগদের সেবায়। বলা যায়, খোলনলচে বদলে যাবে নগদের। ঋণ থেকে শুরু করে সঞ্চয়, অগ্রিম পণ্য ক্রয় সুবিধাসহ নানা সেবা যুক্ত হবে নগদে। তখন একজন গ্রাহক নগদ ব্যবহার করলে তাঁকে কোনো আর্থিক সেবার জন্য অন্য কোথাও যেতে হবে না। অর্থনীতিবিদদের নানা সময়ের নানা তথ্য থেকে আমরা জেনেছি, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার বড়। তাহলে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলো কাদের কাছ থেকে ঋণ নেন, কিংবা কোথায় সঞ্চয় করে? কেউ হয়তো বেসরকারি সংস্থা আবার কেউ মহাজনদের কাছে যান। তাঁদের আমরা নগদের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই।
আমরা জেনেছি, আপনারা প্রবাসী আয় আনার সেবাও চালু করেছেন। কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
তানভীর আহমেদ: আমরা সবাই জানি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। কয়েক মাস আগে যখন দেশে ডলার–সংকট দেখা দেয়, তখন নীতিনির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নেন, সহজে প্রবাসী আয় যাতে দেশে আনা যায়, তার জন্য প্রবাসী আয় আনার পথটি সহজ করতে হবে। বর্তমানে প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ দেশে আসে অবৈধ পথে বা হুন্ডির মাধ্যমে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাদের বলা হয়, প্রবাসী আয় আনার পথটি সহজ করার। তারপর আমরা একটি প্রস্তাব তৈরি করি এবং একটি পাইলট প্রকল্পের অনুমোদন পায়। প্রকল্পের অধীনে একজন প্রবাসী যখন দেশের বাইরে যাবেন, তখন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে তাঁর মোবাইলে নগদ অ্যাপের মাধ্যমে একটি হিসাব খুলে দেওয়া হবে। বিদেশে গিয়ে যেকোনো এজেন্ট বা এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী নগদে অর্থ টপআপ করতে পারবেন। এরপর নিজেই অ্যাপের মাধ্যমে ওই প্রবাসী তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা পাঠাতে পারবেন। যাঁরা ইতিমধ্যে বিদেশে চলে গেছেন, তাঁরাও তাঁদের পাসপোর্ট এবং ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহার করে স্থানীয় মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে নগদে হিসাব খুলতে পারবেন। দেশে আমরা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই শেষে তাঁর সেই হিসাব চালু করে দেব। ইতিমধ্যে বিশ্বের ৫৬টি দেশে আমরা এ সেবা চালু করেছি। তবে এখনো এটি পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। সাড়াও পাচ্ছি ভালো।
গ্রাহক ধরে রাখতে ও নতুন গ্রাহক তৈরি করতে আপনারা কী ধরনের সুবিধা দিচ্ছেন।
তানভীর আহমেদ: আগেই বলেছি, আমাদের গ্রাহকদের বড় একটি অংশ সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত সুবিধাভোগী। এ ছাড়া আমরা বাজারে এসে লেনদেনের খরচ কমিয়ে দিয়েছি। সাধারণ মানুষের মনে এখন গেঁথে গেছে, এমএফএসে লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম খরচ নগদে। তারা হয়তো সুনির্দিষ্টভাবে জানে না খরচ কত। কিন্তু তারা এটা জানে নগদে খরচ কম। তাই এসব গ্রাহক নতুন নতুন আরও গ্রাহক তৈরি করছে। যেকোনো উৎসব সামনে রেখে আমরা সাধারণ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের কথা মাথায় রেখে নানা সুবিধা দিয়ে থাকি। গ্রাহকদের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সেসব মার্চেন্ট বা প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিই, যেখানে অধিক সংখ্যক মানুষ কেনাকাটা করে। আমরা চাই আমাদের সুবিধা যেন সত্যিকার অর্থেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়। শুরু থেকে আমরা সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে এগিয়েছি। এ কারণে ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট সেবা আমাদের কম। আমরা সেসব মানুষকে এ সেবায় যুক্ত করতে চেয়েছি, যাঁরা সব ধরনের আর্থিক সেবার বাইরে ছিলেন। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা মেনে আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিং কার্যক্রমও চালু করতে চাই।