বাজারে চিনির সংকট শুরু হতেই লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন বিক্রেতারা। অস্থিরতা কমাতে মাঠে নেমেছে ভোক্তা অধিদপ্তর।
হঠাৎ দেশের চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বাজারে দেখা দিয়েছে সংকট। এই সুযোগে আরেক দফা দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়েই খোলা চিনির দাম সপ্তাহ ব্যবধানে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। আর সরকার নির্ধারিত ৯৫ টাকা দরের প্যাকেটের চিনিও উধাও। অনেক ক্ষেত্রে প্যাকেট চিনি খুলে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।
গতকাল শনিবার পাইকারি ও খুচরা চিনির ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এখন প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। দুদিন আগে, বৃহস্পতিবার ১০০ টাকার ওপরে উঠেছিল। তাতে দুদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা; আর সপ্তাহ ব্যবধানে বাড়ল ১৫ থেকে ২০ টাকা।
‘আমরা বাজার অভিযানের পাশাপাশি চারটি বড় কোম্পানির কারখানাও পরিদর্শন করেছি। এতে দেখা গেছে, কোনো কোনো কারখানা থেকে গত মাসের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চিনি বাজারে কম সরবরাহ হয়েছে। কোম্পানিগুলো এ জন্য জ্বালানিসংকটের কথা বলেছে।’মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার, ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান নিয়ে সংস্থাটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ)
চলতি মাসের প্রথম দিকে সরকার খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয় প্রতি কেজি ৯০ টাকা। তবে এই দাম কার্যকর হয়নি। গত সপ্তাহের শুরুতেও চিনির দাম কেজিপ্রতি ৯৫ টাকার একটু ওপরে ছিল।
গত এক সপ্তাহে হঠাৎ বাজারে চিনির দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাজার অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকালের এই বিশেষ অভিযানে বাজারে চিনিসংকটের সত্যতা মিলেছে।
সংস্থাটি সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ১৪৮ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অভিযোগে ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানাও করেছে। এদিকে চিনির কারখানাগুলো সরবরাহ কমিয়েছে, এমন চিত্রও ধরা পড়েছে সংস্থাটির কাছে। আবদুল মোনেম, সিটি, এস আলম ও মেঘনা গ্রুপের কারখানা পরিদর্শন করে চিনির সরবরাহ ঠিক রাখার নির্দেশনা দিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক এস এম মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সাধ্য অনুযায়ী চিনি সরবরাহ করে যাচ্ছি। তবে জ্বালানিসংকটের কারণে দিনের একটা সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তাতে উৎপাদন কমেছে। আর উৎপাদন কমলে তখন পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ ঠিক রাখা কঠিন।’
‘কারখানার জন্য প্রতিদিন অন্তত আট কেজি চিনির প্রয়োজন। একসঙ্গে কিনলে কিছুটা সাশ্রয়ী হয়। নিয়মিত যে বিক্রেতার কাছ থেকে চিনি কেনা হয়, তিনি আজ মাত্র ১০ কেজি দিতে পেরেছেন। বাজারে চিনি না পাওয়া গেলে দু-এক দিনের মধ্যে আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।’মাহমুদুল হাসান, মোহাম্মদপুরের ক্লাব কেক পেস্ট্রি অ্যান্ড বেকারির ব্যবস্থাপক
তবে এ পরিস্থিতি শুধু চিনির কারখানার ক্ষেত্রে নয়, অনেক ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন মুজিবুর রহমান।
ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা পরিবেশকদের কাছে চাহিদা জানানোর পরেও প্রয়োজনমতো চিনি পাচ্ছেন না। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, দু–এক বস্তা চিনি পেলেও তা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, তাঁরা কয়েক দিন ধরে পরিবেশকদের কাছে চিনি চেয়েও পাচ্ছেন না। চিনি দেবেন বলে ঘোরাচ্ছেন পরিবেশকেরা।
রাজধানীর কাঁটাবনের ভাই ভাই স্টোরের মুদিদোকানি আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিনির চাহিদা জানালেও পরিবেশকেরা আমাদের আজ না কাল, এমন করছেন। চিনি পাচ্ছি না। এদিকে আজ জানলাম, খোলা চিনির পাইকারি দাম পড়ছে কেজিপ্রতি ১০৫ থেকে ১০৬ টাকা। সংকটে খোলা চিনি বিক্রি বন্ধ রয়েছে। কয়েক কেজি প্যাকেটজাত চিনি আছে। সেটি গায়ের দামেই (কেজিপ্রতি ৯৫ টাকা) বিক্রি করছি।’
মোহাম্মদপুরের ক্লাব কেক পেস্ট্রি অ্যান্ড বেকারির ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানার জন্য প্রতিদিন অন্তত আট কেজি চিনির প্রয়োজন। একসঙ্গে কিনলে কিছুটা সাশ্রয়ী হয়। নিয়মিত যে বিক্রেতার কাছ থেকে চিনি কেনা হয়, তিনি আজ মাত্র ১০ কেজি দিতে পেরেছেন। বাজারে চিনি না পাওয়া গেলে দু-এক দিনের মধ্যে আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।’
চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ৫০টি বাজারে গতকাল বিশেষ অভিযানে নামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ওই অভিযানে অংশ নেয় ভোক্তা অধিকারের প্রধান কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন জেলার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ৫০টি দল।
ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান নিয়ে সংস্থাটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাজার অভিযানের পাশাপাশি চারটি বড় কোম্পানির কারখানাও পরিদর্শন করেছি। এতে দেখা গেছে, কোনো কোনো কারখানা থেকে গত মাসের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চিনি বাজারে কম সরবরাহ হয়েছে। কোম্পানিগুলো এ জন্য জ্বালানিসংকটের কথা বলেছে।’
বাজার পরিস্থিতি অস্থির হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর অজুহাত প্রসঙ্গে মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘সয়াবিনের বাজারে অস্থিরতার সময়েও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এমন কথা শুনেছি। কিন্তু আমরা চাই, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসুক। এ জন্য এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বসব। পরবর্তী সময়ে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হবে।’
ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ (রোববার) ঢাকার কারওয়ান বাজার ও মৌলভীবাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসবে সংস্থাটির মহাপরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে পরের দেন সোমবার একটি মতবিনিময়ের ডাক দিয়েছে সংস্থাটি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সেই সভায় চিনি কোম্পানির প্রতিনিধি, পরিবেশক, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে উপস্থিত থাকবেন সাধারণ ভোক্তারাও।