দেশে ব্যবসার নৈতিকতার বিষয়টি এলে যে কয়জন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার নাম সামনে আসে, তাঁদেরই একজন রোকিয়া আফজাল রহমান। নীতি ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন ও উচ্চকণ্ঠ। যেকোনো পরিস্থিতি ও অবস্থানে তিনি সত্য ও নৈতিকতার কথা দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে পারতেন। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তরুণ কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ সবার সঙ্গে তিনি বন্ধুর মতো মিশতে পারতেন।
প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এভাবেই রোকিয়া আফজাল রহমানের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও গুণাবলির কথা তুলে ধরেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। যাঁরা কর্মক্ষেত্রে তাঁর সান্নিধ্য ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তাঁদেরই একজন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, একজন সফল ও নীতিমান মানুষের যত গুণ থাকে, সবই ছিল রোকিয়া আফজাল রহমানের। এ দেশের নারীদের, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খুবই সক্রিয় ছিলেন।
মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রোকিয়া আফজাল ছিলেন আমার নেতৃত্বাধীন আইসিসিবির সহসভাপতি। দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমরা ছিলাম পারিবারিক বন্ধু। দেশে–বিদেশে পরিবারসহ অনেক জায়গায় আমরা ঘুরেছি। তাঁর মৃত্যুর খবর শোনার পর সেসব স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে।’
মাহবুবুর রহমান বলেন, রোকিয়া আফজাল রহমান এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর ওপর ব্যবসার ক্ষেত্রে, নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে, বিচক্ষণতায় ও কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভরসা করা যেত। নীতির প্রশ্নে তিনি নিজে যেমন ছিলেন অবিচল, তেমনি ব্যবসায় নৈতিকতা মেনে চলতে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করতেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রোকিয়া আফজাল রহমান গতকাল বুধবার ভোরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি ছিলেন এক বর্ণাঢ্য ও সফল জীবনের অধিকারী। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম নারী ব্যাংক ব্যবস্থাপক ছিলেন তিনি।
দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বলছেন, তিনি শুধু সফল উদ্যোক্তাই ছিলেন না, দেশের নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশেও ছিল তাঁর অগ্রণী ভূমিকা। গত ২০ বছর তিনি এ লক্ষ্যে নিরলস কাজ করেছেন। রোকিয়া আফজাল রহমান বিশ্বাস করতেন, ঋণের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে যদি নারীদের জন্য দোকান বরাদ্দের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যে আসতে পারবেন। ২০১৬ সালে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কথাই বলেছিলেন।
নারীদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য ‘মিনি মার্ট’ নামক বিশেষ বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রোকিয়া আফজাল। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মিনি মার্টের দুটি বিক্রয়কেন্দ্র ছিল, যদিও এখন শুধু চট্টগ্রামের বিক্রয়কেন্দ্রটি চালু আছে।
রোকিয়া আফজাল রহমান মনে করতেন, গ্রামের নারীদের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। এতে সারা বাংলাদেশই উঠে আসবে। যাঁরা অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায় আছেন, তাঁদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় আনতে হবে।
আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমানের মতে, ‘কৃষকদের জামানতবিহীন ঋণ দিয়ে নানাভাবে সহায়তা করেছেন রোকিয়া আফজাল। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের একটি ব্যাংকের প্রথম নারী শাখা ব্যবস্থাপক। পরে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা যেমন হয়েছেন, তেমনই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণেও কাজ করেছেন। আবার নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের বড় বড় সব সংগঠনে। ফলে একজন মানুষকে যত গুণের কারণে আইকন হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়, তার সব গুণই ছিল তাঁর। তাই আমার দৃষ্টিতে রোকিয়া আফজাল রহমান ছিলেন একজন “আইকনিক লেডি।”’
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্যবাহী ও শতবর্ষের পুরোনো সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি হিসেবে ২০১৩–১৪ সালে দায়িত্ব পালন করেন রোকিয়া রহমান। একই সংগঠনে ২০০২–০৩ সালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন আমরা একসঙ্গে মেট্রো চেম্বারে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, তাঁর নৈতিকতার মান ছিল খুব উঁচুতে। তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্য ও নীতির কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। এ রকম স্বচ্ছ ও নীতিমান মানুষের সংখ্যা দেশে দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই তাঁর চলে যাওয়া দেশের জন্য বড় ক্ষতি।’
‘আমার বাবা প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরীর সঙ্গে রোকিয়া আফজালের সম্পর্ক ছিল অনেকটা বড় ভাই ও ছোট বোনের মতো। তাই ছোটবেলা থেকে পারিবারিকভাবেই আমরা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে তাঁকে পেয়েছি বন্ধুর মতো। তরুণ কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ যেকোনো মানুষের সঙ্গে তিনি সহজেই বন্ধুর মতো মিশতে পারতেন। তিনি বয়সের বাধা সহজেই ভেঙে ফেলতেন,’ বলেন তপন চৌধুরী।
নারীরা সাধারণত ঋণখেলাপি হয় না, এ বিশ্বাস থেকে মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেডের মাধ্যমে রোকিয়া আফজাল রহমান বন্ধক ছাড়া নারীদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এ ছাড়া উইমেন টু উইমেন সাপোর্ট প্রোগ্রামসহ বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার যাত্রা শুরু হয় তাঁর হাত ধরে। উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউইএ), বাংলাদেশ ফেডারেশন অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরসহ (বিএফডব্লিউই) বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত থেকে নারীদের কল্যাণে কাজ করেছেন তিনি।
তাই বহুজাতিক কোম্পানি বার্জার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী মনে করেন, রোকিয়া আফজালের মূল ভূমিকা ছিল নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। তিনি শুধু মাইডাসের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করেছেন, তা নয়। তাঁদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করেছেন। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। এই উদ্যোক্তাদের অনেকেই ছোট ব্যবসা দিয়ে শুরু করে আজ বড় হয়েছেন। একদম গ্রামের নারীদের তুলে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি।
রোকিয়া আফজাল রহমান ১৯৮২ সাল থেকে মাইডাসের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া শুরু করেন। এরপর ২০০০ সাল থেকে এ ঋণ দেওয়া হয়েছে মাইডাস ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে। মাইডাস ফাইন্যান্সিং এখন পর্যন্ত তিন হাজার নারী উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়েছে। ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি দেড় হাজার নারী উদ্যোক্তাকে উৎপাদন, বিতরণ, বিপণন, বিক্রয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একজন নারী উদ্যোক্তা কীভাবে উৎপাদন করবেন, কীভাবে বা কোন বাজারে সেগুলো নিয়ে যাবেন, সব বিষয়েই প্রশিক্ষণ দিয়েছে মাইডাস ফাইন্যান্সিং।
এ ছাড়া রোকিয়া আফজাল তিন মাস অন্তর অন্তর নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
মাইডাস ফাইন্যান্সিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘রোকিয়া আফজালের মৃত্যুর পরও মাইডাস ফাইন্যান্সিং আগের নীতিতে অর্থাৎ নারী উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। মাইডাস ফাইন্যান্সিং এ নীতিতে অটল থাকবে, কারণ এ নীতি থেকে আমরা ইতিবাচক ফল পেয়েছি।’
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রোকিয়া আফজাল রহমান মাইডাস ফাইন্যান্সের চেয়ারপারসন ছিলেন। এ ছাড়া তিনি মিডিয়া ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেড থেকে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে তিনি মিডিয়াস্টারের পরিচালক ও এবিসি রেডিওর পরিচালক ছিলেন। মিডিয়াস্টার থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত হয়।
এ ছাড়া দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন রোকিয়া আফজাল রহমান।