আইএমএফের দল ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর্থিক প্রভাব এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া কমার বিষয়ে জানতে চেয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির বিকল্প কী, তা জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণদাতা সংস্থাটির সফররত প্রতিনিধিদল বলেছে, বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন খরচ ও বিক্রির মধ্যে ঘাটতি কমাতে মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে। এটি না হলে ভর্তুকির পরিবর্তে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে কী হবে, তা-ও জানতে চেয়েছে তারা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) কমার বিষয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে গতকাল বুধবার বিকেলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব বিষয় জানতে চাওয়া হয়। বৈঠকে ছয় সদস্যের আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ।
আর পিডিবির পক্ষে নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান। বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিস্তারিত তথ্য নিয়েও পিডিবির সঙ্গে আলোচনা করেছে আইএমএফ। মূলত পিডিবির আয়-ব্যয় নিয়েই বিস্তারিত জানতে চেয়েছে তারা।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে তা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা সুদসহ শোধ করতে হবে, এতে পিডিবির বোঝা আরও বাড়বে। পিডিবি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। আর বিদ্যুৎ জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। তাই সরকারের নীতি মেনে জনকল্যাণে তারা কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে পিডিবি কীভাবে চলবে—আইএমএফের এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটি বৈঠকে জানায়, ভর্তুকির বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা মেনেই কাজ করবে পিডিবি।
আইএমএফের দল আরও বলেছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার সর্বশেষ অবস্থা কী।
বৈঠক সূত্র বলছে, ২০৩০ সালের পর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া কমবে কি না, এ বিষয়ে আইএমএফ প্রশ্ন করেছে। জবাবে পিডিবি বলেছে, প্রতিবছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। তাই নতুন নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। এতে বিপুল বিনিয়োগের বিপরীতে কেন্দ্র ভাড়াও বাড়তে থাকবে। এটি কমার কোনো সম্ভাবনা এখনই বলা যাচ্ছে না। এখানে অনেক হিসাব নিকাশের বিষয় আছে।
ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর্থিক প্রভাবও জানতে চেয়েছে আইএমএফ। জবাবে পিডিবি জানিয়েছে, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা আগের চেয়ে কমছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) পিডিবির ২৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির মধ্যে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাচ্ছে মাত্র ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
এর আগে গতকাল সকালে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। বিদ্যুৎ-সচিব হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন একটি দল এতে অংশ নেয়। বৈঠকে উপস্থিত বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মূলত বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়েই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
বিদ্যুৎ বিভাগ তাদের জানিয়েছে, বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজার থেকে আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। এতে দেশের গ্যাস সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ধেক আসে গ্যাস থেকে। জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে গেছে।
তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। জ্বালানি পরিস্থিতি জানতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ অবস্থায় জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে শিগগিরই আইএমএফ প্রতিনিধিদল আলাদা বৈঠক করতে পারে বলে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির বিষয়টি নিয়ে কথা উঠলেও পিডিবির সঙ্গে আলাদা বৈঠক থাকায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের অবস্থা সম্পর্কে আইএমএফ জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আগামী জানুয়ারির মধ্যে পায়রা, রামপাল ও আদানির তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পুরোদমে বিদ্যুৎ চলে আসবে। তারপর বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে সংকট থাকবে না বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
সূত্রগুলো জানায়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে আইএমএফ। তারা এ বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে এ খাতের অগ্রগতি ও পরিকল্পনা তুলে ধরেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। আইএমএফ থেকে যে ঋণ পাওয়া যাবে, তার একটি অংশ ব্যয় হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য হিসেবে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশকেও এর ট্যারিফ বিষয়ে বিধিবিধান মানতে হয়। আইএমএফের বিবেচনায় বাংলাদেশের কিছু পণ্য আমদানিতে এখনো ট্যারিফ হার বেশি। শুধু তা-ই নয়, ট্যারিফ কাঠামোও জটিল। অন্তত এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের ট্যারিফ লাইনের যৌক্তিকীকরণ এবং কাঠামোটির সহজীকরণ চায় আইএমএফ। সংস্থাটি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ট্যারিফ হার কমানোর পথেই রয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা ইতিমধ্যে অনুমোদন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে গড় ট্যারিফ হার ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ থাকলেও ডব্লিউটিওর হিসাব অনুযায়ী, তা ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কী প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ, তা জানতে চেয়েছে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষের নেতৃত্বাধীন একটি দল আইএমএফের সঙ্গে এ বৈঠকে অংশ নেয়।
বৈঠকে বলা হয়, এলডিসির তালিকা থেকে বের হয়ে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কী প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ, তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে সাতটি কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে।
সূত্র জানায়, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তিন বছরের জন্য তৈরি পোশাক ও তৈরি পোশাকবহির্ভূত পণ্যের রপ্তানি প্রাক্কলন জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে যথাসময়ে তথ্য না পাওয়ায় আইএমএফ দলকে তা সরবরাহ করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া তৈরি পোশাকনির্ভরতা কাটিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ পরিস্থিতিও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। দলটিকে জানানো হয়েছে, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যার ফলও পাওয়া যাচ্ছে।
আইএমএফের দল আরও বলেছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার সর্বশেষ অবস্থা কী। ভুটানের সঙ্গে পিটিএ হওয়ার তথ্যসহ যেসব দেশের সঙ্গে এফটিএ ও পিটিএ হওয়ার পথে রয়েছে বাংলাদেশ, সেগুলো তাদের জানানো হয়েছে।