এক দশকের বেশি সময় বিনা ভোটে চট্টগ্রাম চেম্বার দখলে রেখেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজনেরা। তাতে চেম্বারটি চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের বদলে লতিফের চেম্বার হয়ে ওঠে। ১০ বছরে টানা পাঁচবার ভোটের বদলে নিজের পছন্দের লোকদের দিয়ে চেম্বারের নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। যদিও এত দিন ব্যবসায়ীরা সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সাহস পাননি।
গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম চেম্বার নিয়ে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রতিবাদে রূপ নেয়। এমন অবস্থায় পদত্যাগ করে চেম্বারের পুরো পর্ষদ। পদত্যাগের সাত দিনের মাথায় গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম চেম্বারে প্রশাসক বসিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষী এই চেম্বারের পুরো পর্ষদ পদত্যাগের ঘটনা ঘটে এবারই প্রথম। পদত্যাগের আগে চেম্বারের সভাপতি ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ। গত বছরের আগস্টে তিনি চেম্বারের দায়িত্ব নেন। চট্টগ্রাম চেম্বার কার্যালয়টি নগরীর আগ্রাবাদে এম এ লতিফের নির্বাচনী এলাকায়। এ কারণে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে চেম্বারকে তাঁর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চেম্বারে এম এ লতিফের ‘পরিবারতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে দুই দফা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ। এ সময় তাঁরা চেম্বারের পর্ষদ বাতিলের দাবিও তোলেন।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, চেম্বার নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেক দিনের ক্ষোভ রয়েছে। ভোট না হওয়া, ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করা ও চেম্বারে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কারণে সবার মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এখন ব্যবসায়ীরা চেম্বারে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব চান।
* চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হন মাহবুবুল আলম* মাহবুবুল আলমের এখন কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন* সর্বশেষ চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ছিলেন স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ* ভুয়া ভোটার তৈরির মাধ্যমে ২০০৪ সাল থেকে চেম্বারকে নিজের কবজায় নেন এম এ লতিফ* সর্বশেষ এই চেম্বারে নির্বাচন হয়েছিল ২০১৩ সালে
এদিকে সম্প্রতি সব পরিচালকের পদত্যাগের পর নেতৃত্বশূন্য এই চেম্বারে গতকাল প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশাকে। প্রশাসককে ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
যে কারণে চেম্বারে ‘পরিবারতন্ত্র’
চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃত্ব নিয়ে ব্যবসায়ীদের আগ্রহের নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ও মন্ত্রিত্ব। ইংরেজ আমলে ইউরোপীয়রা নেতৃত্ব দিয়েছিল এই চেম্বারের। স্বাধীনতার পর চেম্বারের নেতৃত্ব দেওয়া আটজন ব্যবসায়ী পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই আটজনের মধ্যে চারজন বিভিন্ন সময় মন্ত্রীও হয়েছেন। এ কারণে চেম্বারের নেতৃত্বের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি।
তবে এক দশক ধরে চট্টগ্রাম চেম্বার এম এ লতিফের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চেম্বারকে নিজের দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন এম এ লতিফ। ২০০৮-০৯ মেয়াদে চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় পর পুরো চেম্বার তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেন। ২০০৪ সালে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী চেম্বারের সভাপতি থাকাকালীন সহসভাপতি ছিলেন এম এ লতিফ। ২০০৪ সাল থেকেই চেম্বারের ভুয়া ভোটার তৈরির কাজ শুরু করেন এম এ লতিফ। চেম্বারের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ভোটারের দুই হাজার সরাসরি ব্যবসায়ী নন বলে জানান চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম চেম্বারে সর্বশেষ ভোট হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ। ওই নির্বাচনে এম এ লতিফ সমর্থিত প্যানেল বিজয়ী হন। প্রথমবারের মতো সভাপতি হন মাহবুবুল আলম। চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রতিনিধি হিসেবে বর্তমানে তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি।
চট্টগ্রাম চেম্বারে মাহবুবুল আলম ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ২০১৭-১৯ সাল মেয়াদে বিনা ভোটে পরিচালক হন এম এ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ। এ ছাড়া সদ্য পদত্যাগ করা কমিটির পরিচালক হিসেবে ছিলেন এম এ লতিফের আরেক সন্তান ওমর মুক্তাদির ও মাহবুবুল আলমের মেয়ে রাইসা মাহবুব।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ূন মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ভোট না হওয়ায় চেম্বারের নেতৃত্ব নির্বাচনে ব্যবসায়ীরা তাঁদের মতামত দিতে পারেননি। পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়।
এফবিসিসিআইয়ের কী হবে
এদিকে চট্টগ্রাম চেম্বারের পর্ষদ বাতিল হওয়ায় দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলমের পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি নির্বাচিত হন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইন অনুযায়ী মাহবুবুল আলম এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি থাকতে পারবেন না। কারণ, কোনো বাণিজ্য সংগঠনে প্রশাসক নিয়োগ হলে ফেডারেশনে তার প্রতিনিধিত্ব করা ব্যক্তির পদ থাকে না।
২০২২ সালের বাণিজ্য সংগঠন আইনের ধারা ১৭ এর উপধারা ৪ অনুযায়ী, কোনো বাণিজ্য সংগঠনে প্রশাসক নিযুক্ত থাকাকালীন ওই সংগঠনের কোনো সদস্য ফেডারেশনের নির্বাচনে প্রার্থী বা ভোটার হতে পারবেন না এবং ফেডারেশনের সাধারণ পরিষদে ওই সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব স্থগিত থাকবে।
দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সম্প্রতি মাহবুবুল আলম চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এফবিসিসিআইয়ে প্রশাসক নিয়োগের আবেদন নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগে একটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে।