দেশে প্রথমবারের মতো উচ্চফলনশীল প্রজাতির ভেনামি চিংড়ির রেণু (সদ্য জন্ম নেওয়া পোনা) উৎপাদন শুরু হয়েছে। আগামী এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ নাগাদ বাজারে ভেনামির রেণু পাওয়া যাবে। এর মধ্য দিয়ে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদনের পথে বাংলাদেশ আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে বলে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
দেশে এত দিন সীমিত আকারে ভেনামি চিংড়ির চাষ হলেও রেণু আসত বিদেশ থেকে। বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার প্রায় এক বছর পর অবশেষে রেণু উৎপাদন হতে যাচ্ছে। নিরিবিলি ও দেশ বাংলা নামে দুটি হ্যাচারি রেণু উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে। এর মধ্যে নিরিবিলি হ্যাচারি সুদূর আমেরিকা থেকে ১৫০ জোড়া প্যারেন্টস (মা–বাবা) বা ৩০০টি ভেনামি চিংড়ি কক্সবাজারে নিয়ে এসেছে। এসব ভেনামি প্যারেন্টস থেকে এখন রেণু উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলছে।
নিরিবিলি হ্যাচারির মহাব্যবস্থাপক সুজন বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ নাগাদ ভেনামি ব্রুড থেকে উৎপাদিত রেণু পাওয়া যাবে। আগস্ট মাস পর্যন্ত ৮ থেকে ১০ কোটি রেণু উৎপাদনের লক্ষ্য আছে আমাদের। তবে এসব রেণু খামার পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে সরকারিভাবে চাষিদের উৎসাহ দিতে হবে। একেকটি রেণুর দাম পড়তে পারে এক টাকার ওপরে।’ তবে রেণুর দাম উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে বলে জানান তিনি।
চিংড়িচাষিরা বলছেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি, যেটি বাগদা চিংড়ি নামেই সমধিক পরিচিত। সনাতন উপায়ে খামারে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ৪০০ থেকে ৫০০ কেজির মতো বাগদা পাওয়া যায়। বাগদা চিংড়ি নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই টন পর্যন্ত উৎপাদন করা সম্ভব।
অন্যদিকে নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামি চিংড়ি চাষ করা হলে প্রতি হেক্টরে দ্বিগুণের বেশি চিংড়ি পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ ভেনামির প্রজননের হার অনেক বেশি।
ভেনামি চাষ করছে, এমন একটি প্রতিষ্ঠান খুলনার এম ইউ সি ফুড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শ্যামল দাস প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রেণু বাজারে এলে সেটা সাশ্রয়ী হবে। তবে রেণুর মান ঠিক রাখতে হবে। ফিড বা খাবার উৎপাদনেও জোর দিতে হবে। ভালো ফল পাওয়ায় তাঁরা এবার ২০০ টন ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আগাচ্ছেন বলে জানান এই উদ্যোক্তা।
ভেনামি চাষের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জলজের সহপ্রতিষ্ঠাতা তন্ময় সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু ভেনামি নতুন বিষয়। এর চাষপদ্ধতিও সাধারণ চিংড়ি চাষের মতো নয়। এ জন্য পরামর্শ নিতে অনেকেই আমাদের কাছে আসছেন। তাঁরা ভেনামি চাষের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’
ব্যবসায়ীদের দাবি, সঠিকভাবে ভেনামি চাষ করা গেলে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে এই খাতে রপ্তানি আয় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
জানতে চাইলে চিংড়ি খাতের রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান ক্রিমসন রোজেলা সি ফুডের এমডি দেলোয়ার হোসেন বলেন, উচ্চফলনশীল হওয়ায় ভেনামি চিংড়ির চাষ স্থানীয় বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধি করবে, যা বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববাজারে চিংড়ি রপ্তানির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সহায়ক হবে।
নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের চাষিরাই কেবল ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে আগ্রহী খামারিদের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে।
সরকারি নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য বায়োসিকিউরিটি, সঙ্গনিরোধসহ ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা থাকতে হবে। অনুমোদন পেতে আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত ছকে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে হবে। তবে আবেদন জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট উপজেলা মৎস্য দপ্তরে। আবেদন জমার পর মাঠপর্যায়ের কমিটি সরেজমিনে প্রস্তাবিত ভেনামি চিংড়ির খামার পরিদর্শন করবে। তারা ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে সুস্পষ্ট মতামত জানাবে।
নির্দেশিকা অনুযায়ী, ভেনামি চাষের অনুমতি পাওয়ার পরও বেশ কিছু বিধিনিষেধ মানতে হবে, অন্যথায় চাষের অনুমোদন বাতিল করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে অনুমোদিত খামারের নির্বাচিত স্থানের বাইরে ভেনামি চিংড়ি চাষ না করা এবং অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া কোনো পর্যায়ে এ চিংড়ি স্থানান্তর না করা।
চিংড়ি চাষের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রয়োজন উল্লেখ করে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ভেনামি এলোমেলোভাবে চাষ করা যাবে না। আবার এটা কয়েকজনের হাতে থাকলেও সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। সুতরাং সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে। টেকসই আবাদে যেতে হবে।
কাজী বেলায়েত হোসেন আরও বলেন, বিশ্ববাজারে ভেনামিসহ বাগদা ও অন্যান্য মাছের চাহিদা বেশ ভালো। সেই তুলনায় সরবরাহ করা যাচ্ছে না। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে না। এ জন্য কক্সবাজার ও খুলনা অঞ্চলে আলাদা দুটো অর্থনৈতিক অঞ্চল করা যেতে পারে। তাতে এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলে মনে করেন তিনি।