দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভালো করেছে বেশ কিছু খাতের প্রতিষ্ঠান। যদিও ব্যবসার খরচ অনেকাংশে বেড়েছে।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে করতেই আরেকটি বছর পার করল দেশের অর্থনীতি। বিদায়ী বছরজুড়ে মার্কিন ডলারের সংকটের কারণে হিমশিম খেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই বছরে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হয়নি। শেষ ছয় মাসে ছিল রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও। তারপরও ২০২৩ সালে অনেক উদ্যোক্তা নতুন বিনিয়োগ করেছেন এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে দক্ষতা দেখিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির শ্লথগতি ও বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্যগুলোয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকার পরও বছরটিতে সামগ্রিকভাবে পণ্য রপ্তানি খানিকটা বেড়েছে।
অর্থনীতির কঠিন সময়ে ভালো ব্যবসা করেছে বেশ কিছু খাত ও শিল্পগোষ্ঠী। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদায়ী বছরে কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য পরিবহনের ব্যয় এবং গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খরচ বেড়েছে। তাতে প্রায় সব পণ্যের মূল্য বেড়েছে। ফলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে মুনাফার পালেও হাওয়া লেগেছে অনেকের। তবে পরিচালন ব্যয় বেশ বেড়ে যাওয়ায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে শেষ পর্যন্ত তেমন মুনাফা না–ও থাকতে পারে।
দেশে বিদায়ী ২০২৩ সালে সরকারের কয়েকটি বড় অবকাঠামো চালু হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের একাংশ, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা পর্যন্ত ট্রেন, ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেন চলাচল ইত্যাদি। এসব অবকাঠামো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ গত নভেম্বরে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গোপসাগর থেকে এই টার্মিনালে জাহাজ আসা-যাওয়ার জন্য প্রায় ১৪ কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রপথ এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। ২০২৬ সালে টার্মিনালটি চালুর কথা রয়েছে। এটি চালু হলে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে আগের চেয়ে সময় কম লাগবে। তাতে দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে—এমনই অভিমত ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠানের আমদানির পাশাপাশি পণ্য রপ্তানির ব্যবসাও রয়েছে, তারা সংকটের মধ্যেও ভালো করেছে। আবার আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোও ভালো ব্যবসা করেছে। করোনার ধাক্কা কেটে যাওয়ায় ভালো ব্যবসায় ফিরেছে বেসরকারি বিমান পরিবহন এবং পর্যটন খাতও। ডলারের উচ্চ দামের কারণে ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করে ভালো মুনাফা করলেও ঋণসংক্রান্ত অনিয়মের কারণে অনেক ব্যাংক বছরজুড়েই টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল।
দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবসায় ২০২৩ সালে প্রায় ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাদের মুনাফা বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। সর্বশেষ গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানিটি ২ হাজার ১৬১ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মার নির্বাহী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘নানামুখী সংকট থাকলেও বিদায়ী বছরে আমরা আমাদের ব্যবসার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পেরেছি। বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় শেষার্ধে ব্যবসা ভালো হয়েছে।’
গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ওষুধ খাতের আরও যেসব কোম্পানি ভালো ব্যবসা করেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বেক্সিমকো, এসিআই, ওরিয়ন, এক্মি ল্যাবরেটরিজ, বিকন, ইবনে সিনা ও নাভানা ফার্মা।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট খাতের বিদেশি মালিকানাধীন ও দেশের ভালো মানের কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, তারা বিদায়ী বছরে ভালো ব্যবসা করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। ২০২৩ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ৯ মাসে কোম্পানিটি ৫১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ২০২২ সালের একই সময়ে হাইডেলবার্গ প্রায় ২৪ কোটি টাকা লোকসান করেছিল। হাইডেলবার্গ ছাড়া এ খাতের কোম্পানি লাফার্জহোলসিম, কনফিডেন্স, ক্রাউন সিমেন্টও ভালো ব্যবসা করেছে।
সংকটেও ভালো মুনাফা অর্জনের কারণ কী জানতে চাইলে সিমেন্ট শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির বলেন, গত বছরজুড়ে বাজারে পণ্যের সংকট ছিল। কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় কোনো কোনো কোম্পানির পণ্য বাজারে ছিল না। সেই সুযোগে যাদের হাতে পণ্য ছিল, তারা ভালো ব্যবসা করেছে।
সিমেন্ট খাত ছাড়া শেয়ারবাজারে আবাসন খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইস্টার্ন হাউজিং, সিরামিক খাতের মুন্নু সিরামিকসও গত বছর ভালো ব্যবসা করেছে। তালিকাভুক্ত বহুজাতিক ও ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস (এফএমসিজি) বা নিত্যব্যবহার্য পণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়ে ছিল মিশ্র অবস্থা। এ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি ম্যারিকো গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ভালো ব্যবসা করেছে। তবে দেশের এফএমসিজি বাজারের শীর্ষে থাকা বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারেনি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এফএমসিজি কোম্পানিগুলোর (নিত্যব্যবহার্য পণ্য প্রস্তুতকারক) বিক্রি কমে গেছে। এ ধরনের ব্যবসার মুনাফা নির্ভর করে বিক্রির ওপর। বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় মুনাফাও কমেছে। বছরের শুরুতে আমরা যে পরিকল্পনা করেছিলাম, সে অনুযায়ী ব্যবসা হয়নি। তবে নানামুখী উদ্যোগের কারণে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয়ও ঘটেনি।’
সংকটের মধ্যেও বিভিন্ন খাতে কোম্পানিগুলোর ভালো ব্যবসা করার কারণ সম্পর্কে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এ সময়ে সেসব কোম্পানিই ভালো ব্যবসা করেছে, যাদের আর্থিক সামর্থ্য বেশি এবং ব্যাংক খাতের সঙ্গে যোগাযোগ ভালো। যারা সময়মতো ডলার পেয়েছে এবং কাঁচামাল আমদানি করতে পেরেছে, তারা ভালো ব্যবসা করেছে। এ ক্ষেত্রে যতটা না চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি বেড়ে ব্যবসা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভালো ব্যবসা হয়েছে পণ্যমূল্য বাড়ানোর ফলে। বড়রা এ সুবিধা পেলেও ছোট-মাঝারি কোম্পানিগুলো ভালো করতে পারেনি।
বিদায়ী বছরে ৩০০ কোটি টাকার বেশি নতুন বিনিয়োগ করেছে স্কয়ার গ্রুপ। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও বিনিয়োগ করেছে কোম্পানিটি। স্কয়ার গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গত বছর কেনিয়ায় স্থাপিত স্কয়ার ফার্মার কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ ছাড়া স্কয়ার গ্রুপ তাদের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরীর নামে স্যামসন ফার্মা ইনকরপোরেশন নামে ফিলিপাইনে নতুন কোম্পানি খুলেছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি ৫ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছরটি স্কয়ার ফার্মার জন্য ভালোই ছিল বলে মনে করেন কোম্পানিটির নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় নতুন শিল্পপার্ক স্থাপন করছে। ৪০ একর জায়গায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে শিল্পপার্কটি গড়ে তুলছে তারা। দু-তিন মাসের মধ্যে এই শিল্পপার্কের ওপাল গ্লাসওয়্যার এবং ককশিট কারখানা চালু হবে।
এই শিল্পগ্রুপ গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার মুক্তারপুরে কালীগঞ্জ অ্যাগ্রো প্রসেসিং নামে নতুন একটি শিল্পপার্ক গড়ছে। এই শিল্পপার্কে দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। সেখানে ইতিমধ্যে প্যাকেজিং ও ফিডমিল (প্রাণী খাদ্য) কারখানা আংশিকভাবে চালু হয়েছে। আগামী মার্চে আটা, ময়দা, সুজি ও লবণ কারখানা উৎপাদনে যাবে।
গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যপণ্যের চাহিদা রয়েছে, রপ্তানি বাজারেও সম্ভাবনা আছে। সে জন্যই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমরা বিনিয়োগ করেছি।’
হবিগঞ্জের মাধবপুরের হরিতলা এলাকায় পাইওনিয়ার ডেনিম কারখানার গার্মেন্ট ইউনিট স্থাপনে ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। ২০০ বিঘা জমির ওপর নির্মাণাধীন এই কারখানার ছোট একটা অংশ ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। সেখান থেকে পণ্য রপ্তানিও শুরু হয়েছে। এই কারখানায় ডেনিম পোশাক উৎপাদিত হবে। কারখানাটিতে কাজ করবেন ১৫ হাজার কর্মী। এ ছাড়া অদূরেই শিল্পগ্রুপটির সুতার কল বা স্পিনিং মিলের নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে প্রতিদিন ২০০ টন সুতা উৎপাদিত হবে।
বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা বাদশা মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনে একের পর এক পোশাক ও বস্ত্র কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেই ব্যবসা অন্যত্র স্থানান্তরিত হচ্ছে। ফলে বিদেশি ক্রেতারা আমাদের বিনিয়োগ করতে উৎসাহ দিচ্ছেন। সম্ভাবনা থাকায় আমরাও এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছি।’
এই দুটি শিল্পগোষ্ঠীর মতো হবিগঞ্জে আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে। তার মধ্যে রয়েছে আকিজ বশির, যমুনা গ্রুপ ইত্যাদি। মূলত উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও গ্যাসের সরবরাহ ভালো হওয়ায় এই অঞ্চলে বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা।
হবিগঞ্জে স্থাপিত আকিজ বশির গ্রুপের গ্লাস কারখানা নতুন বছরে উৎপাদনে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির পরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘গত বছর সামগ্রিক বাস্তবতায় বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ হয়নি। তবে আশা করছি, নতুন বছরে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আমাদের নতুন কয়েকটি কারখানা উৎপাদনে আসবে।’
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎসের একটি হচ্ছে পণ্য রপ্তানি। বিদায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর ১১ মাসে দেশ থেকে ৫ হাজার ৪৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ১১৫ কোটি ডলার বেশি। গত বছর অবশ্য রপ্তানির পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন কিছু ব্যবসায়ী। তাঁদের দাবি, রপ্তানি কম হলেও সরকারি পরিসংখ্যানে তা বেশি দেখানো হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী বছরে তৈরি পোশাক ছাড়া বড় খাতগুলোর রপ্তানি কমেছে। বিদায়ী বছরের প্রথম ১১ মাসে ৪ হাজার ৮৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২৮ কোটি ডলার বেশি। আলোচ্য সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমলেও তা কিন্তু বিলিয়ন ডলারের উপরে (১০১ কোটি) ছিল। তার আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১২২ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।