ডলার-সংকট

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, শিল্পে প্রভাব কী 

গত জুলাইয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য মাত্র ১৮ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। 

ডলার
ছবি: প্রথম আলো

ডলার-সংকট থেকে এখনো বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত এক বছরে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটও প্রকট হয়েছে। আবার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা রয়েছে। এসব কারণে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ফলে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ মন্থর হয়েছে দেশে।

একাধিক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে ডলারের সংকট দেখা দেয়। অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যায়। চলতি বছর থেকে বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। তবে বাংলাদেশে ডলার-সংকট দূর হচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়েও দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতিও ১০ শতাংশের আশপাশে আটকে আছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৮৫ কোটি ডলারের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। আমদানির এই পরিমাণ তার আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ কম। যন্ত্রপাতি আমদানির এই নেতিবাচক প্রবণতা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। 

গত জুলাইয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য মাত্র ১৮ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়। গত বছরের একই মাসে খোলা হয়েছিল ২৩ কোটি ডলারের ঋণপত্র। তার মানে, জুলাইয়ে ঋণপত্র খোলা কমেছে ২২ শতাংশ। অন্যদিকে গত জুলাইয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ২৯ কোটি ডলারের। গত বছরের জুলাইয়ে নিষ্পত্তি হয়েছিল সাড়ে ২৯ কোটি ডলারের ঋণপত্র। তার মানে, এবার ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। 

জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো প্রকল্প নিচ্ছেন না। তা ছাড়া কয়েক মাস ধরে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশও কম। এ জন্য পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা তাঁদের কারখানা সম্প্রসারণ বা সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছেন না। সব মিলিয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। 
আবুল কাশেম মো. শিরিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক

ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেবল অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে রপ্তানিকারকেরা কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন। তিনি আরও বলেন, জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো প্রকল্প নিচ্ছেন না। তা ছাড়া কয়েক মাস ধরে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশও কম। এ জন্য পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা তাঁদের কারখানা সম্প্রসারণ বা সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছেন না। সব মিলিয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। 

অবশ্য শুধু যে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে তা-ই নয়, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিই কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে। গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এরপর কখনোই তা ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। 

বস্ত্র খাতের মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভাবনা থাকায় উৎপাদন বাড়াতে গত দুই বছরে বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা ২০ লাখ স্পিন্ডল আমদানির জন্য বিদেশি কোম্পানিকে ক্রয়াদেশ দিয়েছিলেন। গত বছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কেউ কেউ তা আমদানিও করেন। তারপর অর্থনীতিতে সংকট শুরু হলে অনেক উদ্যোক্তা স্পিন্ডল আমদানি পিছিয়ে দেন। কেউ কেউ ক্রয়াদেশ বাতিলও করেন। তার কারণ হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমে গিয়েছিল। আবার ডলার-সংকটে কাঁচামাল আদৌ আমদানি করা যাবে কি না, সেই অনিশ্চয়তাও ছিল। সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট তো আছেই। 

বিটিএমএর এই সহসভাপতি বলেন, বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে হলে আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা দরকার। ঋণপত্র খুলতে আজকে ডলারের এক দাম, কাল আরেক দাম থাকলে এবং ডলারের সংকট থাকলে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা করবেন না। 

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাসের প্রভাব ইতিমধ্যে অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। শ্রমশক্তি জরিপ তথ্যানুসারে, দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে এর আগের তিন মাস; অর্থাৎ ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকের তুলনায় দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৭০ হাজার বেড়েছে। পরের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বেকারের সংখ্যা অবশ্য কমেছে—৯০ হাজার। সব মিলিয়ে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যয় বাড়লেও শিল্প খাতের শ্রমিকের মজুরি সেভাবে বাড়েনি। ক্রয়াদেশ কম থাকায় বেশ কয়েক মাস ধরে অনেক কারখানায় ওভারটাইম বন্ধ রয়েছে বলে জানান পোশাকশিল্পের মালিকেরা। 

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূলধনি যন্ত্রপাতির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। যার মানে, বিনিয়োগের নতুন উদ্যোগ আসছে না। পুরোনো উদ্যোক্তারাও ব্যবসা সম্প্রসারণে যাচ্ছেন না। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমছে। ইতিমধ্যে এসবের নেতিবাচক প্রভাব কর্মসংস্থানে দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। এখান থেকে বের হতে না পারাটা দুশ্চিন্তার। কারণ, বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। 

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে বৈশ্বিক নয়, অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বেশি দায়ী। ফলে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মধ্যেই সমাধান খুঁজতে হবে। বিদ্যমান সমস্যা দূর করার মাধ্যমে প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি বাড়িয়ে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে অর্থ পাচার বন্ধ ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে উদ্যোগ দরকার। এসব বিষয়ের দিকে নজর দেওয়ার ওপর নির্ভর করছে বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নয়ন।