জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক ও কর আদায়ের হিসাবে যে গরমিল হয় তা ঠিক করা হবে। বিদায়ী ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ ক্ষেত্রে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার গরমিল হয়েছে। প্রতিবছরই এমন হয়ে থাকে। এনবিআরের আদায়ের পরিমাণ বেশি থাকে, অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে তা কম দেখা যায়। দীর্ঘদিন ধরেই এ প্রবণতা চলছে।
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই গরমিল ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে ২৯ আগস্ট বৈঠক হবে। এতে এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। সবাই নিজেদের ব্যাখ্যা দেবেন। এভাবে সব পক্ষের সম্মতি নিয়ে রাজস্ব আদায়ের হিসাব সমন্বয় করা হবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, শুল্ক-কর আদায়ের হিসাব ঠিক করার উদ্যোগটি ভালো। রাজস্ব ও রপ্তানি খাতের গত কয়েক মাসের হিসাবের পার্থক্য দেখলাম। বিগত সরকারের আমলে এমনটা বেশি হয়েছে। কখনো কখনো উদ্দেশ্যমূলকভাবে তা করা হয়েছে। তবে রাজস্ব আদায়ের তথ্যের আদান–প্রদানসহ সবকিছুর অটোমেশন করা উচিত।
কীভাবে পার্থক্য হয়
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মোট ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার রাজস্ব (শুল্ক ও কর) আদায় করেছে। কিন্তু হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয়ের হিসাবে দেখা যায়, কোষাগারে জমা হয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দুই হিসাবের পার্থক্য প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব * এনবিআর আদায় করেছে মোট ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা।* হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কোষাগারে জমা হয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। * দুই সংস্থার হিসাবে পার্থক্য দাঁড়ায় প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এনবিআর সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের (জুলাই–জুন) বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের হিসাব করে থাকে। যদি অর্থবছর শেষ হওয়ার পর জুলাই মাসেও আগের অর্থবছরের কোনো অর্থ জমা পড়ে, তা–ও আগের অর্থবছরের রাজস্ব আদায় হিসেবে দেখানো হয়। যেমন জুন মাসের ভ্যাটের রিটার্ন জমা দেওয়া যায় জুলাই মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত। সেখানে কমবেশি ৮ হাজার কোটি টাকা জমা পড়ে। এটি এনবিআরের হিসাবে আগের অর্থবছরে দেখানো হয়।
অন্যদিকে হিসাব মহানিয়ন্ত্রক বা সিজিএর কার্যালয় হিসাব করে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইবাস হিসাব থেকে। ৩০ জুন পর্যন্ত যত অর্থ জমা পড়ে, তা–ই দেখাবে সিজিএর হিসাবে। সে জন্য ভ্যাট রিটার্ন বাবদ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা গরমিল থেকে যায়। এ ছাড়া আইবাস সিস্টেমে অনেক মন্ত্রণালয় যুক্ত হয়নি। যেমন প্রতিরক্ষা ও রেলপথ মন্ত্রণালয়। আইবাসে যুক্ত না হওয়া মন্ত্রণালয়গুলো থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব পাওয়া যায়, তা সিজিএর হিসাবে আসে না বলে দাবি করেন এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা।
গত কয়েক মাসের মধ্যে রাজস্ব ও রপ্তানি খাতের হিসাবের পার্থক্য দেখলাম। বিগত সরকারের আমলে এমনটা বেশি হয়েছে। কখনো কখনো উদ্দেশ্যমূলকভাবে তা করা হয়েছে।সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আইবাস অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের তালিকা ও রাজস্ব আদায়ের পরিমাণের হিসাব ২৯ আগস্ট আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের আগে করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে গতকাল সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে দীর্ঘদিন ধরেই দুই প্রতিষ্ঠানের হিসাবের পার্থক্য চলছে। বছর শেষ হওয়ার পর যে পার্থক্য দেখা যায়, কয়েক মাসে যেতে না যেতেই তা কমে আসে। এই পার্থক্য সমন্বয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
কয়েক বছর ধরেই এই পার্থক্য বেশি হচ্ছে। অবশ্য এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশি রাজস্ব আদায় দেখানোর উৎসাহও দেখা যায়। রাজস্ব আদায়ের পার্থক্য বেশি থাকার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। ওই বছরে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ১৩ হাজার কোটি টাকার পার্থক্য ধরা পড়ে। অভিযোগ আছে, সরকারের সুনজরে থাকতে তখন রাজস্ব আয় বাড়িয়ে দেখানোর চেষ্টা করতেন এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।