গভর্নর সম্প্রতি বলেছেন, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টির মতো ভালো অবস্থায় আছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮-১০টি ব্যাংক একীভূত হতে পারে।
বিলম্বে হলেও দুর্বল ব্যাংক একীভূত (মার্জার) করার ঘোষণা আসায় ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনাটি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি থেকে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের নিজেদের মতো করে একীভূত হওয়া বা করার আলোচনা শুরু করতে বলা হয়েছে।
অথচ কয়েক বছর আগেও সরকারের নানা পর্যায় থেকে ‘শক্তিশালী ব্যাংক খাত’ নিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা খাতটির সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে এলেও তা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এত দিন। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই যখন এই সংস্কারের কথা বলছে তখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তারা এত দিন কী করেছিল। কারও কারও প্রশ্ন, এই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দিয়ে খাতটির সংস্কার করা কতটা সম্ভব হবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকে গত বুধবার অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টির মতো ব্যাংক ভালো অবস্থায় আছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮-১০টি ব্যাংক একীভূত হতে পারে। এ জন্য ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুর পরামর্শ দেন তিনি।
তবে গভর্নর এই আলোচনার সূত্রপাত করেছেন গত ডিসেম্বরে জারি করা ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ শীর্ষক নীতিমালার মাধ্যমে। ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হবে।
ওই নীতিমালা অনুযায়ী, মূলত পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর মান বা শ্রেণি নির্ধারণ করা হবে। সেগুলো হলো ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ (সিআরএআর), টিয়ার-১ ক্যাপিটাল রেশিও বা মূলধন অনুপাত, কমন ইক্যুইটি টিয়ার-১ (সিইটি১) রেশিও, নিট খেলাপি ঋণ এবং করপোরেট গভর্ন্যান্স বা সুশাসন। পাঁচ সূচকে লাগাতার পতন হলে সব শ্রেণির ব্যাংককে ‘অনিরাপদ’ ও ‘আর্থিকভাবে অস্বাস্থ্যকর বা দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরপর দুই ক্যাটাগরিতে অবনতি হলে সবচেয়ে ‘দুর্বল’ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। দুর্বলতা কাটিয়ে ব্যাংকের মানোন্নয়নে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে কোনো ব্যাংককে একীভূত করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই নীতিমালা অনুযায়ী, একীভূত হওয়ার
আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংক একীভূত করতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং কাজ শুরু করতে হবে।
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা খুবই সময়োপযোগী উদ্যোগ। এতে ব্যাংক খাতে অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করি। তবে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে ভালো ব্যাংক কীভাবে একীভূত করা হবে, এটা নিয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার অপেক্ষায় আছি। নীতিমালা করা হলে এ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারবে ব্যাংকগুলো।’
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকগুলোর যে আর্থিক সূচক দেখা যাচ্ছে, তা অনেকটা সাজানো। প্রকৃত চিত্র আরও খারাপ। খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা। এর সঙ্গে বেনামি ঋণ যুক্ত করলে তা বেড়ে ৬ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাবে। সংস্কার করতে হলে আগে প্রকৃত চিত্র বের করতে হবে, এরপরই সংস্কারের জন্য একীভূত করা যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রমে যুক্ত তিনজন কর্মকর্তা প্রথম আলাকে বলেন, সরকারি পদে থাকা একজনের ব্যাংকে গত ৫ বছর ধরে পরিদর্শন হচ্ছে নিয়ম রক্ষার্থে। আবার এখন ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকেরও একই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি টিকিয়ে রাখতে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিতে হচ্ছে। এর বাইরে নতুন ও পুরোনো কয়েকটি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এসব ঠিক না হলে সংস্কারের আলোচনা অর্থহীন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে চলছে, তাতে প্রকৃত অর্থে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে প্রভাবশালীদের ব্যাংকগুলো দুর্বল তালিকার বাইরে থেকে যাবে। প্রকৃত সংস্কারের বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সবুজ সংকেত পেলেই কেবল ব্যাংক খাত ঠিক হবে, এর আগে নয়।
ফলে এই সংস্কার কতটা প্রকৃত হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।