৮১৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফারইস্টের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম আবার কারাগারে

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামকে আবারও কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতের এক আদেশে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।

নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৮১৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাহবাগ থানায় মামলা রয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন। অনেক দিন জেল খেটে তিনি জামিনে ছিলেন। ফারইস্ট লাইফ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আজ নজরুল ইসলামের মামলার শুনানি ছিল। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে তাঁর উপস্থিতিতেই শুনানি হয়। বাদীপক্ষের আইনজীবী তাঁর জামিনের বিরোধিতা করেন। শুনানি শেষে আদালত তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় আসামি এম এ খালেক ও নজরুল ইসলাম বিমা কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে থাকাকালে ৮১৬ কোটি টাকার সম্পদ ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আলাদা মামলা রয়েছে নজরুল ইসলাম ও কোম্পানির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান এম এ খালেকের নামে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন নজরুল ইসলাম। বাড়িটির ঠিকানা ১১৫২২ মানাতি বে এলএন, ওয়েলিংটন, এফএল ৩৩৪৪৯। ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাড়িটি কেনা হয়েছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৭ মার্কিন ডলার দিয়ে। বাড়ি কিনতে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি অর্থাৎ পুরো অর্থই একবারে পরিশোধ করা হয়। এ ছাড়া ছেলেমেয়ের নামে মো. নজরুল ইসলাম একই রাজ্যে গড়ে তুলেছেন তিনটি কোম্পানি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একসময় ভালো বিমা কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি ছিল ফারইস্ট ইসলামী লাইফের। ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ওপর করা এক বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে কোম্পানিটি থেকে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এর বাইরে অনিয়ম হয়েছে ৪৩২ কোটি টাকার। কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকসহ কোম্পানির সাবেক সব পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্লাহ এবং কোম্পানির কিছু শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটান।

তিন উপায়ে আত্মসাৎ

বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কেনা, বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ফারইস্টের মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে পরিচালকদের ঋণ নেওয়া ও ক্ষতিকর বিনিয়োগ—মূলত এই তিন উপায়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে। এমটিডিআর হচ্ছে একধরনের স্থায়ী আমানত।

২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে জমি কেনে। এসব জমি কেনা হয় বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। এর মধ্যে সাতটি জমি কেনা, ভবন নির্মাণ ও বালু ফেলার নামে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ির ৭৮৬ শতাংশ জমি ১৯৯ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে বলে হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এ জমি কেনা হয়েছে ১৯ কোটি টাকায়। ১৯৯ কোটি টাকার মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে চেকে দেওয়া হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, কেডিসি কনস্ট্রাকশন ও মাহবুবা অ্যাসোসিয়েটকে চেকে দেওয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকা ও রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ চেকে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা দেওয়া হয়েছে নগদে।

কোম্পানির ৭২ কাকরাইলের জমি কেনায় ১৬০ কোটি এবং গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউয়ের জমি কেনায় ৮৯ কোটি, গুলশানের আরও দুই জমিতে ৮০ কোটি এবং বরিশালের আলেকান্দায় এক জমি কেনায় ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

দলিলে কী ছিল

তিনটি দলিল সংগ্রহ করে দেখা গেছে, কাকরাইলের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের শ্বশুর মো. মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে। জমি বিক্রির পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাছলিমা ইসলামকে ১১৫ কোটি টাকা উপহার দেন মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদ। তাছলিমা ইসলাম আবার সেখান থেকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন তাঁর স্বামী নজরুল ইসলামকে।

তোপখানা রোডের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের বন্ধু নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দুই সহোদর মো. সোহেল খান ও মো. আজাহার খানের কাছ থেকে। আর মিরপুর চটবাড়ির নিচু এলাকার জমি কেনা হয়েছে ২০ জন বিক্রেতার কাছ থেকে। দলিলগুলোতে বলা হয়েছে, জমির মালিকদের টাকা দেওয়া হয়েছে নগদে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বিমা আইন অনুযায়ী, পাঁচ হাজার টাকার বেশি হলেই লেনদেন করতে হয় ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমটিডিআর বন্ধক রেখে ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের একাংশ। এর মধ্যে এম এ খালেক, প্রাইম প্রোপার্টি, প্রাইম ফাইন্যান্স, ম্যাকসন্স ও মিজানুর রহমানের নামে বন্ধক রেখে ৫৪২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারইস্টের এমটিডিআর বন্ধক রেখে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির নামে ১৬৪ কোটি, পিএফআই প্রোপার্টিজের নামে ১৬০ কোটি, ফারইস্ট প্রোপার্টিজের নামে ১৫১ কোটি, প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ৯২ কোটি, মিথিলা প্রোপার্টিজের নামে ৬৪ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ৫৫ কোটি, মিথিলা টেক্সটাইলের নামে ৪৮ কোটি, কে এম খালেদের নামে ২১ কোটি, মোল্লা এন্টারপ্রাইজের নামে ২০ কোটি, আজাদ অটোমোবাইলসের নামে ৯ কোটি ও কামাল উদ্দিনের নামে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

এ ছাড়া বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিকর বিনিয়োগের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ২৮৭ কোটি টাকার তহবিল আত্মসাৎ করেন কোম্পানিটির সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। এর মধ্যে বাংলালায়ন কনভার্টেবল জিরো কুপন বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪০ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৩২ কোটি, প্রাইম ফিন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪ কোটি, আল-ফারুক ব্যাগসে বিনিয়োগের মাধ্যমে ২ কোটি ও কর্মকর্তাদের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব দেখিয়ে ৮৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।